E-Paper

অভিযোগ লেখার অফিসার কই? মহিলা থানা চলছে কনস্টেবলেই

সমস্যায় পড়ে থানায় গেলে কেমন অভিজ্ঞতা হয়? দ্রুত কি পরিষেবা মেলে? শহরতলির একাধিক থানা ঘুরে দেখল আনন্দবাজার।

নীলোৎপল বিশ্বাস, চন্দন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২৫ ০৯:৩৪
বিধাননগর মহিলা থানা।

বিধাননগর মহিলা থানা। ছবি: সংগৃহীত।

থানায় সাব-ইনস্পেক্টর, অতিরিক্ত সাব-ইনস্পেক্টর মিলিয়ে অফিসার পদে হাতে গোনা পাঁচ জন। সাব-ইনস্পেক্টরই থানা-প্রধানের দায়িত্ব সামলান। কিন্তু দুপুর রোদে থানায় ঢুকে দেখা গেল, তাঁরা কেউ নেই। ডিউটি অফিসারের টেবিলও ফাঁকা! কয়েক জন মহিলা হাতে টিফিন বাক্স নিয়ে ঘুরছেন। এক জন চেয়ারে গা এলিয়ে মোবাইল দেখছেন। আর এক জন আবার সদ্য ডেলিভারি পাওয়া হাতঘড়ির বাক্স খুলে বাকিদের দেখাতে ব্যস্ত। কারও পরনেই পুলিশের উর্দি নেই।

কেউ আছেন? ডাক শুনে টিফিন বাক্স হাতে ঘুরে বেড়ানো মহিলাদেরই এক জন এগিয়ে এসে নিজেকে কনস্টেবল বলে পরিচয় দিলেন। ডিউটি অফিসারের টেবিল ফাঁকা কেন? অভিযোগনেবেন কে? মহিলা বললেন, ‘‘বলুন না, আমরা কনস্টেবল, সিভিকেরা তো রয়েছি! আসলে পাঁচ জন অফিসারের দু’জন অসুস্থ হয়ে ছুটিতে। থানার দায়িত্বে থাকা সাব-ইনস্পেক্টরও সদ্য ছুটিতে গিয়েছেন। দিনকয়েক বাদে ফিরবেন। দুইঅতিরিক্ত সাব-ইনস্পেক্টরের এক জন গিয়েছেন এক জায়গায় ডিউটি করতে। অন্য জন টেবিল অফিসারের ডিউটি করছিলেন। তাঁকেও নগরপালের অফিস থেকে জরুরি কারণে ডেকে নেওয়া হয়েছে।’’ এখন কেউ অভিযোগ করতে এলে কী হবে? অভিযোগ লেখার অফিসারই তো নেই! মহিলা কনস্টেবল বললেন, ‘‘কিছু ক্ষণ ঘুরে আসতে বলব। খুব গুরুতর কিছু হলে ডিউটি অফিসারকে ফোনে খবর দেব। তিনি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে!’’

এক দুপুরে বিধাননগর মহিলা থানায় গিয়ে এমনই পরিস্থিতি চোখে পড়ল। অথচ, তথ্যপ্রযুক্তি তালুক সেক্টর ৫-এ কাজে আসা মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এক সময়ে সেখানে তৈরি করা হয়েছিল এই থানা। সেখানকার পুলিশকর্মীরাই জানালেন, নারী নিগ্রহ থেকে ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ প্রায়ই আসে ওই থানায়। সে সব নিয়ে ওই মহিলা থানায় প্রাথমিক মামলা হয় ঠিকই, কিন্তু কর্মীর অভাবে বেশির ভাগ ঘটনার তদন্তভারই তুলে দিতে হয় পাশের থানার হাতে। মহিলা কনস্টেবল বলছিলেন, ‘‘বহু সময়েই অভিযোগকারিণীকেমহিলা থানার মহিলা পুলিশকর্মীর বদলে পাশের থানার পুরুষ পুলিশকর্মীর প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হতে হয়। বার বার একই কথা বলতে বলতে বিরক্তিতে অনেকে যেমন মামলাই তুলে নেন, অনেকে আবার পরিষেবা পাবেন না ভেবে মহিলা থানায় আসেনই না।’’

পাশের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায় গিয়েও দেখা গেল, পরিস্থিতি তেমন আলাদা নয়। থানায়দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ঘরে নেই। বিশাল টিভির সামনে সোফায় বসে এক জন। টিভিতে চোখ রেখেই বললেন, ‘‘বড়বাবু তো বিশ্রাম নিতে গিয়েছেন। সন্ধ্যার আগে দেখা হবে না।’’ গেটে বন্দুক হাতে দাঁড়ানো মহিলা পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘আমি আর ডিউটিঅফিসার আছি। বলার থাকলে সেখানে বলতে পারেন।’’ ডিউটি অফিসারকে বলা হল, কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার অভিযোগ জানাতে আসা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘‘উৎসবের ডিউটি চলছে। খুব চাপ। এ নিয়ে এত চিন্তার কী আছে? পরে লিখে এনে অভিযোগ জানাবেন।’’অফিসারের সামনের টেবিলের কাচে লাগানো রয়েছে একটি ফোন নম্বর। পরিষেবা সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলে তাতে জানাতে বলা হয়েছে।কিন্তু বার বার করেও সেই নম্বরে ফোন গেল না। একই অবস্থা ছিল মহিলা থানার ল্যান্ড ফোন নম্বরেরও। ফোন করায় বার বার শোনা গিয়েছে, ‘আপনি একটি ভুল নম্বর ডায়াল করেছেন!’

যাওয়া হয়েছিল বাগুইআটি এবং লেক টাউন থানাতেও। বাগুইআটি থানার সামনে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকা এক তরুণ বললেন, ‘‘মেসের জন্য জগৎপুরের কাছে একটি ঘর ভাড়ায় নিতে দু’হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলাম। একটি মেয়ের কয়েকটি ব্যাগ ঘরে রাখা ছিল। এখন ঘরের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মালিক বলছেন, কথা মতো ১৫ হাজার টাকা পুরো ভাড়া না দিলে ব্যাগ নিতে দেবেন না। যে ঘর ব্যবহারই করলাম না, সেটির ভাড়া দেব কেন? পুলিশ বলছে, এখানে এটাই হয়! ওরা কিছুই করতে পারবে না।’’

উদ্‌ভ্রান্তের মতো ফিরে যেতে দেখা গেল আর এক মহিলাকে। অনলাইনে লাইক-কমেন্ট করলেই টাকা মিলবে, এই মোহে পা দিয়ে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা খুইয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ তাঁকে বলেছে, ‘‘আমাদের জিজ্ঞাসা করে কাজ করেছেন? ধরে নিন, টাকা আর পাবেন না।’’ কাঁদতে কাঁদতে মহিলা বলেন, ‘‘আমার পাঁচ বছরের বাচ্চা আছে। স্বামী জানেন না। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জানতে পারলে খুব সমস্যায় পড়ে যাব।’’ তাঁকে তদন্তের আশ্বাস দেওয়ার কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। জানা গেল, বড়বাবু উপস্থিত নেই।

লেক টাউন থানাতেও দেখা মেলেনি প্রধান অফিসারের। সেখানকার এক অফিসার বললেন, ‘‘লোকের যা অভাব, তাতে কী ভাবে কী করব? ভিআইপি ডিউটি দিতে দিতেই জেরবার। বড়কর্তাদের বুঝতে হবে, এত কম লোকে থানা চলে না।’’ বিধাননগরের নগরপাল শ্রী মুকেশকে বার বার ফোন করা হলেও ধরেননি। উত্তর দেননি মেসেজের।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

police police station

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy