Advertisement
E-Paper

ফণীর চক্রব্যূহ ভেঙে সফল আপৎমিত্ররা, প্রশাসনের তূণে নয়া হাতিয়ার

শুক্রবার রাতে ওড়িশায় আঘাত হানার পরে এ রাজ্যের বুকে রামনগরেই প্রথম ধাক্কা মারে ফণী। রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর, উদয়পুর সৈকতে তাণ্ডব চালায় ফণীর প্রবল ঝোড়ো হাওয়া।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ১৮:০৬
ফণীর তাণ্ডব রুখতে আপৎমিত্ররাই এ বার তুরুপের তাস হয়ে উঠেছিল রাজ্য প্রশাসনের কাছে। —নিজস্ব চিত্র।

ফণীর তাণ্ডব রুখতে আপৎমিত্ররাই এ বার তুরুপের তাস হয়ে উঠেছিল রাজ্য প্রশাসনের কাছে। —নিজস্ব চিত্র।

মাত্র তিন মাস আগেই চারটে সাইক্লোন রিলিফ সেন্টারের চাবি পূর্ত দফতরের কাছ থেকে হাতে পেয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর‌ ১-এর বিডিও আশিসচন্দ্র রায়। এত তাড়াতাড়ি যে সেই সাইক্লোন রিলিফ সেন্টার কাজে লেগে যাবে, তা ভাবেননি তিনি।

ওড়িশার গা ঘেঁষা পূর্ব মেদিনীপুরের এই ব্লকটির একটা বড় অংশই উপকূল। শুক্রবার রাতে ওড়িশায় আঘাত হানার পরে এ রাজ্যের বুকে রামনগরেই প্রথম ধাক্কা মারে ফণী। রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর, উদয়পুর সৈকতে তাণ্ডব চালায় ফণীর প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। ফণীর দাপটে ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত ফুলে ওঠে সমুদ্রের জল। কিন্তু, তার পরেও শনিবার সকালে রাজ্য সরকারি এই আমলার মুখে চওড়া হাসি। কারণ একটাই, ৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ফণীর তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতি হলেও, কোনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও পরিস্থিতি অনুসারে বলা যায় নামমাত্রই।

ফণীর তাণ্ডব রুখতে সজাগ ছিলেন আপৎমিত্ররা। - নিজস্ব চিত্র

শনিবার নিজের অফিসে বসে আশিসবাবু স্বীকার করেন, “ঠিক ১০ বছর আগে পরিস্থিতিটা অনেকটাই আলাদা ছিল। ২০১৯ সালে আয়লা তছনছ করে দিয়েছিল বাংলার উপকূলবর্তী একাধিক জেলা। ঘটেছিল অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা। ১০ বছর পরে ফণী কিন্ত রাজ্যের বুক থেকে কোনও প্রাণ কাড়তে ব্যর্থ।’’ এর পিছনে আবহাওয়া দফতরের আগাম সতর্কতাকেই সবচেয়ে বড় অ্যাডভান্টেজ বলে মনে করছেন আশিসবাবুর মতো সরকারি কর্তারা। শনিবার আশিসবাবু বলেন, ‘‘পয়লা মে নবান্ন থেকে আমরা ফণী সংক্রান্ত সতর্কবার্তা পেয়ে যাই। ফলে আমরা দুটো গোটা দিন হাতে পাই, পরিস্থিতি মোকাবিলা করার, প্রস্তুতি নেওয়ার।’’

আরও পড়ুন: অনেক আগেই নিখুঁত পূর্বাভাস, সঙ্গে আগাম তৎপরতা, ফণী যে কারণে আয়লা হয়ে উঠতে পারল না

পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পার্থ ঘোষও ফুল মার্কস দিয়েছেন দেশের আবহাওয়া দফতরকে। তিনি বলেন, “অনেক আগে থেকে সতর্কবার্তার পাশাপাশি সাইক্লোনের গতিবিধি এবং চরিত্র জানিয়ে দিয়েছিল আবহাওয়া দফতর। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফণী নিয়ে আপডেট দিয়েছে। তার ফলে এক দিকে যেমন প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া গিয়েছে, সেই সঙ্গে পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত পরিকল্পনা করাও সম্ভব হয়েছে।” আবহাওয়া দফতরের পাশাপাশি বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য রাজ্যের মাইক্রো প্ল্যানিংকেও সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি বলে মনে করেন পার্থবাবু।

ফণীর দাপট রুখতে কাজে এসেছে আবহাওয়া দফতরের আগাম সতর্কবার্তাও। —নিজস্ব চিত্র।

আয়লার ক্ষত থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য রাজ্য সরকার কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তার মধ্যে এক দিকে যেমন রয়েছে, সাইক্লোন বা বন্যাত্রাণ শিবির তৈরি করা। অন্য দিকে রয়েছে, আপৎমিত্র নামের বাহিনী তৈরি করা। ২০১৮ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে ৪০০ যুবক-যুবতীকে বিপর্যয় মোকাবিলা করার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই কর্মসূচিকে একটি পাইলট প্রোজেক্ট হিসাবে গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, প্রত্যন্ত এলাকাতেও স্থানীয় ছেলেমেয়েদের বিপর্যয় মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ থাকলে দমকল বা বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী পৌঁছনোর আগেই তাঁরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজে নামতে পারবেন। সেই সঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য পারদর্শী বাহিনীকে সাহায্য করতে পারবেন। কারণ, এই যুবক-যুবতীরা নিজেদের এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাকে হাতের তালুর মতো চেনেন।

ফণীর তাণ্ডব রুখতে এই আপৎমিত্ররাই এ বার তুরুপের তাস হয়ে উঠেছিল রাজ্য প্রশাসনের কাছে। আশিসবাবু বলেন, ‘‘নবান্ন থেকে ফণীর খবর পেয়েই যোগাযোগ করা হয় ব্লকের উপকূলবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী আপৎমিত্রদের সঙ্গে। ১ তারিখ দুপুরের মধ্যেই তাঁরা কাজ শুরু করে দেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা থেকে শুরু করে কাঁচা বাড়ির তালিকা তৈরি করা, সেখানকার বাসিন্দাদের সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, এনডিআরএফ এবং রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে এলাকার প্রয়োজনীয় জায়গায় পৌঁছে দেওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে হাতে হাতে মিলিয়ে কাজ করা— সবটাই করেছেন এই আপৎমিত্ররা। তাই ফণীর তাণ্ডব রুখতে প্রশাসনের সাফল্যের পিছনে আপৎমিত্রদের বড় অবদান আছে বলে মনে করেন প্রশাসনিক কর্তারা।

আরও পড়ুন: ফণী নিয়ে ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের ভূমিকার প্রশংসায় রাষ্ট্রপুঞ্জ

শনিবার দুপুরেও রামনগর বিডিও অফিসে দেখা মিলল সৌরভ রথ, বিজয় সাহু, সুকল্যাণ দলুইয়ের মতো আপৎমিত্রদের। সৌরভ বলেন, ‘‘আমাদের প্রথমেই বলা দেওয়া হয়েছিল, ক্ষয়ক্ষতি যা হয় হোক, কিন্তু আগে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে। এক জন মানুষেরও যেন প্রাণহানি না হয়।’’ সেই টার্গেট সামনে রেখেই শুক্রবার বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই আপৎমিত্ররা প্রবল বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে টহল দেন সৈকতলাগোয়া গ্রামগুলোতে। সৌরভ বলেন, ‘‘শুক্রবার দুপুরের মধ্যেই অধিকাংশ মানুষকে আমরা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেও অনেকেই জেদ করে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে চাইছিলেন না। ঝড়ের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের প্রায় জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয় সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টারে।’’

ফণী সম্পর্কে স্থানীয়দের ওয়াকিবহাল করতে তৎপর ছিল বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও। —নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই আবহাওয়া দফতরের আগাম সতর্কবার্তা, প্রশাসনের সঠিক সময়ে পদক্ষেপ করা এবং গ্রাম স্তরে প্রশাসনের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা— এই তিন ফ্যাক্টরেই আয়লা থেকে আলাদা হয়ে রইল ফণী। ফণীকে হারিয়ে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী এই আপৎমিত্রদের দল। তাঁরা তৈরি হচ্ছেন আবার নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে। কিন্তু, সৌরভদের আক্ষেপ একটাই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপর্যয়ের মোকাবিলা করলেও তাঁদের জীবনের ন্যূনতম বিমাটাও নেই। ফণীকে চ্যালেঞ্জ ছোড়া আপৎমিত্র সৌরভদের সারা বছরে কোনও কাজ নেই। বিপর্যয় ঘটলে তবেই তাঁদের ডাক পড়ে। মেলে দিনপিছু ৪৬০ টাকা। এক জন দক্ষ শ্রমিকের মজুরি!

(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেবাংলায় খবরজানতে পড়ুন আমাদেররাজ্যবিভাগ।)

Cyclone Fani ফণী Video
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy