ফাইল চিত্র।
শুধু কিছু বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এসেছিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যেরা। তা নিতেই ফ্রেজারগঞ্জের লক্ষ্মীপুর গ্রামে ভিড় উপচে পড়ল। কে নেই সেই ভিড়ে! শিশু, মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধবৃদ্ধাও।
বৃহস্পতিবারের দুপুর। চারদিকে নোনা জল থইথই করছে। তার মধ্যেই উঁচু রাস্তায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন কৃষ্ণা মণ্ডল, প্রমীলা বেরার মতো ছাপোষা গ্রামবাসীরা। কী করবেন, জানেন না। কোথায় যাবেন, জানেন না। হঠাৎ ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খাবার এনেছে শুনেই দৌড়লেন।
‘‘দু’দিন ধরে কিছু খেতে পাইনি। খোলা আকাশের নীচে অনাহারে রয়েছি। আমরা বড়রা তবু না-খেয়ে থাকতে পারি। বাড়ির শিশুরা যে খিদেয় কান্নাকাটি করছে। তাই যা পাই...।’’— প্রমীলার গলা বুজে আসে!
ইয়াস এবং জলোচ্ছ্বাসের পরে কেটে গিয়েছে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়। বৃহস্পতিবার বিকেলে বকখালির অমরাবতী গ্রামের পূর্ণিমা বিশ্বাস, প্রতিমা শিকদাররা দুপুরে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিলেন। আগের দিন দুর্যোগের সময় হোটেলের ত্রাণ শিবিরে ছিলেন। দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরে ফিরে দেখেন, তাঁদের টিনের ছাউনির কুঁড়েঘরের কোনও অস্তিত্ব নেই। পাশের বাড়ি থেকে ত্রিপল চেয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু করতে পেরেছেন কোনওমতে।
খাবারের জন্য হাহাকার পূর্ণিমা, প্রতিমার গলাতেও, ‘‘শিবিরে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। বাড়িতে রান্না করার মতো কিছুই নেই। দু’দিন ধরে প্রায় অনাহারে রয়েছি। জানি না কবে খেতে পাব।’’ লক্ষ্মীপুর-হাতিকর্নার গ্রামের পরিতোষ সর্দার জানালেন, নেতারা তাঁদের এ দিন সন্ধ্যায় খিচুড়ি খাওয়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু যা পরিস্থিতি, না-আঁচালে বিশ্বাস নেই।
কেন সরকারি ত্রাণের চিঁড়ে-গুড়টুকুও মিলছে না?
সাগরের বিধায়ক তথা সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা বলেন, ‘‘সাগর এলাকায় ত্রাণ শিবিরে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলেও বকখালি-ফ্রেজারগঞ্জে করা যায়নি। চেষ্টা করছি। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবেন।’’ আজ, শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যারে হেলিকপ্টারে করে সাগরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে আসছেন। তাঁর বৈঠক করারও কথা রয়েছে বলে বিধায়ক জানিয়েছেন।
বিপর্যয়ের এক দিন পরে, ওই দুই এলাকায় যে সব ঘরবাড়ি কোনওমতে টিকে রয়েছে, তা-ই বসবাসের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন দুর্গতেরা। কিন্তু সেটাও কঠিন লড়াই। কারও কাছে বিশেষ টাকাপয়সাও নেই। সরঞ্জাম কিনবেন কী দিয়ে? করোনা পরিস্থিতিতে অনেকের কোনও কাজই ছিল না।
ফ্রেজারগঞ্জের লক্ষ্মীপুর গ্রামের তপন জানার কথাই ধরা যাক। দরমার দেওয়াল এবং অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া ঘরটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ জনের পরিবার। এ দিন সেই কুঁড়েঘরে তাপ্পি মারছিলেন তপন। তাঁর অবস্থার কথা জানতে চাওয়ায় শুধু একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করলেন, ‘‘কী করব বলতে পারেন? মাথা গুঁজব কোথায়? দেখি, কতটা কী করতে পারি! জানি না কপালে কী আছে!’’
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্যোগে বকখালির সমুদ্র লাগোয়া লক্ষ্মীপুর-দাস কর্নার, হাতি কর্নার, বিজয়বাটী, শিবপুর, কালীস্থান, পশ্চিম অমরাবতী, পুর্ব অমরাবতীর মতো-সহ বেশ কিছু গ্রামের সব কাঁচাবাড়ি ধূলিসাৎ হয়েছে। কিছু বাড়িকে সমুদ্র গিলেছে। পুকুরে নোনা জল ঢুকে মাছ মরে পচে যাচ্ছে। বকখালির কংক্রিটের সমুদ্রবাঁধের স্ল্যাব ভেঙে গিয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। সৈকতের ঝাউয়ের জঙ্গল তছনছ হয়ে গিয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বকখালির হরিণ প্রকল্পের প্রাচীর ভেঙে যাওয়ায় ২২টি হরিণ এবং দু’টি কুমির ভেসে গিয়েছে বলে বন দফতর জানিয়েছে। পাশের নামখানাতেও বহু গ্রাম জলমগ্ন। বিষধর সাপ আশ্রয় নিচ্ছে গৃহস্থের ঘরে। নোনা জল ঢোকায় ঘরে ঘরে রান্নাবান্না বন্ধ। পানীয় জলের হাহাকারও শুরু হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy