বেশ কয়েক দিন জ্বর ছিল। ছিল গাঁটে গাঁটে ব্যথাও। কিন্তু তখন রক্ত পরীক্ষায় কিছু মেলেনি। একটু সুস্থ বোধ করায় রোগী কাজে যোগ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে মাথা ঘুরে পড়লেন। অফিসের লোক বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে গেল। অনেক পরীক্ষার পাশাপাশি বাড়ির চিকিৎসক আর এক বার ডেঙ্গি পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। এ বার ধরা পড়ল ডেঙ্গি।
চিকিৎসক বললেন, ডেঙ্গির জীবাণু শরীরে বাসা বেঁধেছিল আগেই। তার জন্যই আগেকার জ্বর ও গায়ে ব্যথা। কিন্তু এমন ভাবে জীবাণু শরীরের ভিতরে লুকিয়ে ছিল রক্ত পরীক্ষায় তা ধরা দেয়নি। এখন জীবাণুর বংশবৃদ্ধি হওয়ায় তা আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি।
প্রথমে পেটে গ্যাস, চোঁয়া ঢেকুর। তার পর পেট খারাপ। অম্বলের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু। বাড়ির চিকিৎসক লিভারের কিছু পরীক্ষা দিলেন। দেখা গেল লিভারের কোষগুলি নষ্ট হতে বসেছে। চিকিৎসক হেপাটাইটিসের বি, সি-র সঙ্গে ডেঙ্গি পরীক্ষা করাতে দিলেন। দেখা গেল হেপাটাইটিস বি বা সি জীবাণুর সংক্রমণ হয়নি। লিভারের কোষগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গির ভাইরাসের জন্য।
চিকিৎসক বললেন, ডেঙ্গির জীবাণু নানা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আক্রান্ত হয়েছে লিভার। লিভারেই লুকিয়ে ছিল জীবাণু। পুরো চাপটা পড়েছে লিভারে। অন্য উপসর্গ না থাকায় রোগটা কী, তা ধরা যায়নি। তবে হেমারেজিক ডেঙ্গি হয়নি। তা হলে রোগ ধরা পড়ার আগেই রোগী চলে যেতেন ‘শক’ পর্বে।
ডেঙ্গি ও অজানা জ্বরের মোকাবিলায় উপসর্গভত্তিক চিকিৎসাই দাওয়াই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। কিন্তু উপসর্গই যদি বিভ্রান্ত করে সে ক্ষেত্রে কী উপায়, তা নিয়ে চিকিৎসকেরা উদ্বিগ্ন। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের এক অবসরপ্রাপ্ত পরজীবী বিজ্ঞানীর মন্তব্য, ‘‘আমরা এক সময় জানতাম প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্সের জন্য যে ম্যালেরিয়া হয় সেটা নিরীহ। তাতে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া হয় না। এই ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুভয় তেমন নেই। কিন্তু এখন তো ভাইভাক্স ম্যালেরিয়াতেও মৃত্যু হচ্ছে। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার জন্ম দিচ্ছে আপাত ‘নিরীহ’ ভাইভাক্স।
ওই পরজীবী বিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ, ম্যালেরিয়া এককোষী প্রাণী। তাদের জীবনচক্র ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ারদের থেকে একটু জটিল। তাই জিনের চরিত্র বদলে মানুষকে বোকা বানানোটা তাদের পক্ষে কঠিন। কিন্তু সেই এককোষী ম্যালেরিয়ার জীবাণুও এখন নিজেদের জিনগত চরিত্র বদলে ফেলছে। ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ারা তো চরিত্র বদলে অভ্যস্ত। আবহাওয়া ও পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়াদের বহুরূপী চরিত্রকে জটিল করেছে। তাই যখনই এক একটা সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে ছড়াচ্ছে, তখন সঙ্কট বাড়ছে। রোগ চেনা যাচ্ছে না।
পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর যেমন বক্তব্য, ‘‘ডেঙ্গি রোগটা এমন ভাবে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে, ছড়িয়ে পড়ছে এবং মৃত্যু ঘটাচ্ছে, তার জন্য একটা টিকা তৈরির প্রয়োজন পড়েছে। একটা টিকা তৈরিও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা প্রয়োগ করা যাবে কি না, তা নিয়ে দোটানায় পড়েছেন টিকা নির্মাতারা। কারণ, যে ভাবে ডেঙ্গি ভাইরাস দ্রুত তার চরিত্র বদলাচ্ছে, তাতে সেই টিকায় কোনও কাজ নাও হতে পারে।’’
মেডিসিন-এর শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার অন্য কিছু দিক সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ দিন আগে ধরা পড়ে না ডেঙ্গি। অনেক ল্যাবরেটরির পরীক্ষাও সঠিক মানের হয় না। আর একটা কারণও হতে পারে। ডেঙ্গির ভাইরাসের যে চারিত্রিক লক্ষণ, তা এমনই বদলে যাচ্ছে যে পরীক্ষায় এটা ধরা পড়ছে না।’’
এখন উপায়? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, যে সময় যেখানে যে রোগটার প্রাদুর্ভাব ঘটে তার ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন, বর্ষার আগে-পরে জ্বর, পেট খারাপ, গায়ে ব্যথা এমনকী সর্দি-কাশি হলেও ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার উপস্থিতি জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। ম্যালেরিয়ার উপসর্গ খুব পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তবুও ডেঙ্গির সঙ্গে ম্যালেরিয়ার রক্ত পরীক্ষা করে রাখাটা মন্দের ভাল বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধরা না পড়লে ডেঙ্গির চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘প্যারাসিটামল আর পর্যাপ্ত জল ডেঙ্গির মূল চিকিৎসা। জ্বর, গায়ে হাত-পা, মাথায় ব্যথা না থাকলে প্যারাসিটামলও দরকার নেই। কিন্তু জলটা খেয়ে যেতেই হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীর থেকে অতিরিক্ত জল বের হয়ে ‘শক’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাতেই মৃত্যু হয় রোগীর। অতিরিক্ত জল সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচাবে।’’
উল্টো বিপত্তির ভয়ও আছে। অমিতাভবাবু বলেন, ‘‘আমার কাছে অনেকে আসছেন, অতিরিক্ত জল খেয়ে যাঁদের পেট ফুলেছে (অ্যাসাইটিস)। এক রোগ সারাতে গিয়ে অন্য বিপত্তি ঘটাচ্ছেন। শরীর কতটা জল চাইছে সেটা অনুমান করে খেতে হবে। অতিরিক্ত জল খেলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।’’