Advertisement
E-Paper

না-বলা বাণীর মন্ত্রে গাঁটছড়া

মঙ্গলবার সন্ধ্যা। নিউ ব্যারাকপুরের সাত নম্বর রেলগেটের কাছে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে বিয়ের আসর।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:৪৬
ইচ্ছেপূরণ: সুমন্ত ও পারমিতার বিয়েতে সাঙ্কেতিক ভাষায় মন্ত্র পাঠে রজনী বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার নিউ ব্যারাকপুরে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ইচ্ছেপূরণ: সুমন্ত ও পারমিতার বিয়েতে সাঙ্কেতিক ভাষায় মন্ত্র পাঠে রজনী বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার নিউ ব্যারাকপুরে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বিয়ে শেষে বরের টোপরের দিকে তাকিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো হল, ওটা কিন্তু তত হালকা নয়। পাল্টা হাত নেড়ে বরের জবাব: ‘‘সে কী আর বুঝি না!’’ দু’হাতের আঙুল দেখিয়ে তিনি বোঝালেন, কুড়ি বছরের গভীর প্রেমের কাহিনি। ‘শুনে’ ডগমগ কনেবৌ। ৪০ বছরের সুমন্ত ঘোষ এবং ৩৪-এর পারমিতা ঘোষ— দু’জনেরই জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার!

মঙ্গলবার সন্ধ্যা। নিউ ব্যারাকপুরের সাত নম্বর রেলগেটের কাছে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে বিয়ের আসর। পুরুতমশাই ডাকার আগে যুগলের সঙ্গে রসিকতা করছিলেন, মূক-বধিরদের ভারতীয় ‘সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ’ বিশারদ রজনী বন্দ্যোপাধ্যায়। দম্পতির অনেক দিনের বন্ধু রজনী যেন ‘বরের ঘরের পিসি-কনের ঘরের মাসি’! বরকনে-সহ জড়ো হওয়া ৫০-৬০ জনের জমায়েতের বেশির ভাগই বর ছাদনাতলায় ঢোকার সময়ে উলুধ্বনি টের পাননি। কানে ঢোকেনি শানাইয়েরও আলাপ। তা বলে বিয়েবাড়ির আনন্দের ভাগে ছিটেফোঁটা কম পড়েনি।

গড়পড়তা বিয়ের তুলনায় সময় লেগেছে বেশি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হয়ে সব কিছু মিটতে প্রায় রাত ১০টা। তবু পুরুতমশাই মানস গঙ্গোপাধ্যায় উত্তেজিত, ‘‘এমন বিয়ে আগে কখনও দিইনি। যাঁরা কানে শোনেন, তাঁরাও তো নমো-নমো করে মন্ত্র পড়ে বিয়ে সারেন। এমন শান্তশিষ্ট মনোযোগী পাত্রপাত্রী কদাচ খুঁজে পাই।’’ পারমিতা-সুমন্তের ইচ্ছে ছিল, ঠাকুরমশাই কী বলছেন, না-বুঝে বিয়ে করবেন না। পুরোহিতের সঙ্গে সঙ্গে আকার-ইঙ্গিতের ভাষায় বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান, মন্ত্র বোঝানোর দায় নিয়েছিলেন রজনীই। আর এক বন্ধু মেরি গোমসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পুরোহিতের সব নির্দেশ ‘শোনালেন’ যুগলকে।

রজনীর ঠাকুরদাও মূক-বধির ছিলেন। বাবা রামেশ্বরবাবু রাজাবাজারের ক্যালকাটা ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তাঁর সঙ্কেতে বরকনে সূর্যপ্রণামের মন্ত্র ‘শুনে’ কখনও মাথার উপরে তাকিয়ে জোড় হাত করেছেন। ‘যদিদং হৃদয়ং তব’র পরেই রজনীর দেখাদেখি নিজেদের বুকের কাছে হাত রেখে মিলনের অঙ্গীকারও ধ্বনিত হল। নিমন্ত্রিত মূক-বধির দম্পতি কবরডাঙার শ্রাবন্তী ও গোপু কয়াল আফসোস করছিলেন, ‘‘ইস! আমাদের বিয়ের সময়ে মন্ত্রটন্ত্র কিছুই শুনতে পাইনি!’’ তবে সপ্তপদী বা মালাবদলের সময়ে কে কখন এগোবে, এই সব খুঁটিনাটি নবদম্পতিকে শেখাতে তাঁরাও উৎসাহে কম যান না।

এ দেশে ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের (আইএসএল) স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হুইলচেয়ার-বন্দি তরুণ সমাজকর্মী নিপুণ মলহোত্র। তাঁর দায়ের করা জনস্বার্থ মামলাটি অবশ্য দিল্লি হাইকোর্টে ধোপে টেকেনি। আকার-ইঙ্গিতের এ ভাষা এখনও সরকারি ভাষার তকমা পায়নি। কিন্তু জনপরিসরে বা গণমাধ্যমে আইএসএলের প্রয়োগ বাড়ানো বা মান্য অভিধান তৈরিতে কিছু নজর দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। নিপুণের কথায়, ‘‘দিল্লির একটি গির্জায় রবিবারের প্রার্থনাসভায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার হয়। কিন্তু হিন্দু মতের বিয়েতে এ ভাষার প্রয়োগ আগে শুনিনি।’’ ওই দিন বিয়ের রেজিস্ট্রিও সেরেছেন দম্পতি।

সুমন্ত পারিবারিক ব্যবসা ছাড়াও মূক-বধিরদের কল্যাণে নানা কাজের শরিক। একটি বিপণির ছোটখাটো কর্মী পারমিতা নিজের টাকায় বরকে আংটি উপহার দিয়েছেন। কিছু জটিলতায় বিয়েটা পিছিয়ে যাচ্ছে দেখে বন্ধুরাই বিয়ের আয়োজনে বরের পাশে দাঁড়ান। কেরল থেকে হাজির মূক-বধির বন্ধু প্রশান্ত কৃষ্ণ এ বিয়ের আলোকচিত্রী। কচুরি থেকে ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন ভোজের পরে সক্কলে বাসর জেগেছেন। তখন শানাই নয়। হিন্দি গানের ‘বিটে’ নাচানাচির ধুম। বিশেষ ভাবে সক্ষমদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় সমাজকর্মী শম্পা সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘শরীরে-মনে প্রতিবন্ধকতা থাকলে বিয়ের অধিকার নিয়েও লড়তে হয়। সেখানে মূক-বধির মানুষেরা অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছেন দেখে ভাল লাগছে।’’

Marriage Deaf and Dumb Sign Language
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy