সকাল হেলে বারবেলা।
কৃষ্ণনগর আদালত চত্বরে ছোট ছোট জটলা। সেই জটলার মধ্যেই শাশুড়ির গা ঘেঁষে বসেছিলেন বছর তিরিশের এক মহিলা। পরনে মলিন বাসন্তী রঙের শাড়ি। কোলে বছর দুয়েকের সন্তান নিয়ে নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন তিনি। শাশুড়ির হাত দু’টো ধরে করুণ আকুতি, ‘‘মা, ফাঁসি দেবে না তো গো?’’
ওই মহিলা একা নন, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই এই একটা প্রশ্ন নানা মুখে ঘুরে বেড়িয়েছে আদালত চত্বরে। ঘুঘড়াগাছির অপর্ণা বাগ হত্যা মামলার সাজা শুনতে কৃষ্ণগঞ্জের নাথপুর, পিরপুর, খাটুরা, মাজদিয়া থেকে ছুটে এসেছিলেন আসামির পরিবারের লোকজন।
ফাঁসি না কি যাবজ্জীবন, আশঙ্কার প্রহর গুনছিলেন সকলেই। দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। কৃষ্ণনগরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক (তৃতীয়) পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় মঙ্গলবার ১১ জনকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। এ দিন তিনি সবাইকেই ফাঁসির সাজা শোনান।
আদালতের এজলাসেও এ দিন সকাল থেকেই চিত্রটা ছিল আর পাঁচটা দিনের থেকে একেবারে আলাদা। সাজা ঘোষণার পর থেকে আইনজীবীরাও যেন মুখিয়ে ছিলেন বিচারক কী সাজা ঘোষণা করেন তা জানার জন্য। বৃহস্পতিবার এজলাস উপচে পড়েছিল আইনজীবীদের ভিড়ে। এই মামলার দু’পক্ষের আইনজীবীরা তো ছিলেনই, ছিলেন অন্য আইনজীবীরাও।
এ দিন আদালতে পুলিশি নিরাপত্তা ছিল চোখে পড়ার মতো। একটা নাগাদ আসামিদের নিয়ে প্রিজন ভ্যান এসে পৌঁছয় আদালতে। একে একে আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয় এজলাসে। লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা প্রথম থেকেই মনমরা হয়ে ছিল। কেউই কারও সঙ্গে কথা বলছিল না। লঙ্কা দাঁড়িয়েছিল এক পাশে। বিচারক এজলাসে ঢুকতেই লঙ্কা হাত দু’টো পিছনে রেখে মাথা নিচু করে। আগের সেই হাবভাব, ঝাঁঝ বিলকুল গায়েব। যা দেখে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলতেও শোনা গেল কয়েক জন আইনজীবীকে।
এর পরে বিচারক আসামিদের দিকে তাকিয়ে কোন আইনে কী সাজা তা শোনান। লঙ্কা তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। তারপর সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় উল্লেখ করে যখন ফাঁসির প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন তখন এক বার চমকে উঠতেও দেখা যায় লঙ্কাকে। তখনও অবশ্য বিচারক সাজা ঘোষণা করেননি। এর মধ্যে বার দুয়েক বিচারকের মুখের দিকে তাকায় লঙ্কা। সেই সময়ে রীতিমতো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে।
এর পরেই বিচারক ১১ জনেরই ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেন। মুহূর্তে এজলাস জুড়ে পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। আসামিদের একজন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘হুজুর, আমার দু’টো বাচ্চা আছে। দয়া করে ফাঁসি দেবেন না।’’ সঙ্গে-সঙ্গে কেঁদে ওঠে আরও কয়েক জন। প্রাণভিক্ষা চাইতে থাকে। চকিতে কাঁদতে থাকা লোকগুলোর দিকে এক বার তাকাল লঙ্কা। তার পর ফের মাথা নিচু করে আবার একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। বিচারকের উদ্দেশে একটি কথাও তাকে বলতে দেখা গেল না। শুধু এরই মধ্যে কাঠগড়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশকর্মীর সঙ্গে তাকে কিছু একটা বলতে দেখা গেল। পরে অবশ্য ওই পুলিশকর্মীকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
আদালতের এক আইনজীবীর মন্তব্য, ‘‘আমরা তো ভেবেছিলাম ফাঁসির সাজা শোনার পরে লঙ্কা হয়তো বিচারককে কিছু বলবে। কিন্তু তেমন কিছুই তো করল না!’’ এর পরে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে ফের নিয়ে যাওয়া হয় কোর্ট লক-আপে। এই ফাঁসির কথা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আদালত চত্বরে। ওঠে কান্নার রোল। কেউ মাথা ধরে মাটির উপরে বসে পড়েন। কেউ পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেন। কেউ আবার প্রিজন ভ্যানের পিছনে ছুটে একবারের জন্য হলেও কথা বলতে চাইল প্রিয়জনদের সঙ্গে।
আসামিদের পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন অনেকেই। তাঁরা আশ্বস্ত করছিলেন, ‘‘এর পরে তো হাইকোর্ট রয়েছে। সেখানে গেলে নিশ্চয়ই সাজা রদ হয়ে যাবে।’’ আসামিদের নিয়ে যাওয়ার পরেই ফাঁকা হয়ে আসে আদালত চত্বরের ভিড়। তবে এ দিন যাঁরা আদালতে এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই নিজেদের পরিচয় গোপন করতে চাইছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন ঘুঘড়াগাছি প্রসঙ্গ থেকে দূরে থাকতে। এ দিন অনেককেই দেখা গিয়েছে এই মামলা কিংবা তাঁদের প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু কাছে গিয়ে কোনও প্রশ্ন করতেই হয় তাঁরা ভিড়ে মিশে যাচ্ছিলেন, নাহলে তাঁরা ঢুকে পড়ছিলেন কোনও দোকানের মধ্যে।
শাশুড়ির গা ঘেঁষা বছর তিরিশের মহিলাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনারা কি চাইছেন? প্রশ্ন শুনেই তাঁরা কান্না চেপে কোনও রকমে জবাব দেন, ‘‘ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা এসেছি অন্য মামলায়। আমাদের বাড়িও ঘুঘড়াগাছি এলাকায় নয়।’’
তবে তাঁরা যে সত্যিটাকে গোপন করছেন তা স্পষ্ট হয়ে গেল পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘুঘড়াগাছি এলাকার এক বাসিন্দা বলছিলেন, ‘‘দেখুন আমরা সকলেই এই বিষয়টি নিয়ে অনেক ভুগেছি। নতুন করে কথা বাড়িয়ে আর কোনও বিতর্ক বাড়াতে চাই না।’’
আর সত্যিই তো তাঁদের বাড়ি ঘুঘড়াগাছিতে নয়। পাশের নাথপুরে।
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।