Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নিঃশব্দেই পাকানো হয় নৈশাহারের সলতে

দুপুরে টোস্ট থেকে নৈশাহারের চাইনিজ— এগারো মাস পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুকুল রায়ের পুনর্মিলনে একটি আকস্মিকতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার পিছনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আবহও রয়েছে বলে মনে করছেন রাজধানীর রাজনীতিকেরা।

খোশমেজাজে। নয়াদিল্লিতে নিজের বাসভবনে মুকুল রায়। বৃহস্পতিবার ইয়াসির ইকবালের তোলা ছবি।

খোশমেজাজে। নয়াদিল্লিতে নিজের বাসভবনে মুকুল রায়। বৃহস্পতিবার ইয়াসির ইকবালের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

দুপুরে টোস্ট থেকে নৈশাহারের চাইনিজ— এগারো মাস পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুকুল রায়ের পুনর্মিলনে একটি আকস্মিকতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার পিছনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আবহও রয়েছে বলে মনে করছেন রাজধানীর রাজনীতিকেরা। তাঁদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই পুনর্মিলন জরুরি হয়ে উঠেছে দু’তরফেই। আর তার প্রেক্ষাপট রচনার কাজটি শুরু হয়েছিল বেশ কিছু দিন ধরে।

মুকুল নিজে আজ সকালে সংসদ চত্বরে এবং বিকেলে সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গত কালের সাক্ষাৎকে ‘সৌজন্যমূলক’ এবং ‘স্বাভাবিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি কখনও দল-বিরোধী বিবৃতি দিইনি। দলও আমায় তাড়ায়নি। দল ভাল মনে করেছে তাই রেলমন্ত্রী করেছিল। আবার যখন মনে করেছে পিছনের বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছে।’’ নৈশাহার সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘‘সময় সব কিছু ঠিক করে দেয়।... আমাদের দীর্ঘদিনের পুরনো সম্পর্ক। গত কাল অতীতের ভালমন্দ দিন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, একুশে জুলাইয়ের কথা উঠেছিল।’’

দলীয় সূত্রের খবর, মমতা এবং মুকুলের মধ্যে এই পুনর্যোগাযোগের সম্ভাবনার দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায়। ভাইফোঁটার পারিবারিক অনুষ্ঠানে তৃণমূল নেত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে মুকুল-প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, দীর্ঘদিন পর এই প্রথম ফোঁটা নিচ্ছেন না তিনি। তার পর প্রকাশ্য সভায় মমতার প্রশস্তি করে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নেত্রীর সঙ্গে তাঁর নৈকট্য। গত কালও সেই নৈকট্যেরই বাহ্যিক প্রকাশ দেখা যায় যখন রাতে মমতা উপস্থিত দলীয় সাংসদদের বলেনন, সকালে মুকুলকে ভাল করে খাওয়ানো হয়নি। ওঁকে খাবার পাঠানো হোক। এ কথা বলার পরেই মত পাল্টে মমতা বলেন, খাবার পাঠানোর কী দরকার, মুকুলকে ডেকে পাঠালেই তো হয়। দিল্লি এসে মমতা যেখানে উঠেছিলেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলোর পাশের বাংলোতেই থাকেন মুকুল। ডেরেক ও’ব্রায়েন গিয়ে ডাকামাত্র মুকুল চলে আসেন মমতার দরবারে।

তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে যে, এর মানে এই নয় যে এখনই মুকুলকে তাঁর হৃতপদগুলি সব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। চটজলদি কোনও সিদ্ধান্ত নিলে দলে যে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ তৈরি হতে পারে তা জানেন নেত্রী। তৃণমূল সাংসদেরা, যাঁরা এত দিন মমতার নির্দেশে সংসদের রণকৌশল সামলেছেন, অথবা রাজ্যে যাঁরা মুকুলের অনুপস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক কাজকর্ম সামলাচ্ছেন, তাঁদের কোনও ভাবেই অসন্তুষ্ট করতে চান না মমতা। ভোটের আগে সেটা কাম্যও নয়। ফলে মুকুল যে আবার আগের মতো তৃণমূলের জেলাওয়াড়ি কাজকর্ম দেখতে শুরু করবেন, এমন নয়। বরং দিল্লিতে দলের কাজে ধীরে ধীরে সক্রিয় হবেন তিনি।

তৃণমূল সূত্রের খবর, গত কাল রাতে মুকুলকে ‘অতীত ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকাতে’ বলেছেন নেত্রী। রাজ্যে রেলের কিছু প্রকল্প নিয়ে আর্জি জানানোর জন্য ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছেন মুকুল। আজ তিনি বলেন, ‘‘আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সময় পেয়ে যাব।’’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই সাক্ষাতে কোনও রাজনীতি থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন মুকুল। তিনি বলেন, ‘‘সেন্ট্রাল হলে বিভিন্ন দলের সাংসদদের সঙ্গে এমনিতেই দেখা হয়ে যায়। এই যেমন আজ সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’’ সূত্রের খবর, চন্দন মিত্রের সঙ্গেও সেন্ট্রাল হলে

আজ এক প্রস্ত গল্প করেছেন মুকুল।

তবে মুকুলকে দলীয় সংগঠনে আগের মতো সক্রিয় করে তোলার আগে আরও একটি সমস্যা সমাধান করার প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেক তৃণমূল নেতা। তাঁদের মতে, বিভিন্ন জেলায় মুকুল অনুগামীদের সঙ্গে (যাঁরা গত দশ মাস মুকুলকে তৃণমূলের থেকে পৃথক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে দেখে এসেছেন) তৃণমূলের কর্মীদের যাতে কোনও সংঘাত না-হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মুকুল অবশ্য আজ বলেন, ‘‘তৃণমূলের কর্মীরই তো আমার কর্মী ও সমর্থক। আমার আলাদা কোনও সমর্থক নেই।’’

এখন প্রশ্ন হল, মুকুলকে কাছে টেনে নেওয়ার এই প্রক্রিয়া কেন শুরু করলেন নেত্রী? মুকুলই বা কেন প্রায় এক বছর ধরে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে, কংগ্রেস ও বাম নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতা করে, এমনকী বকলমে একটি দল গড়ার প্রক্রিয়া শুরু করেও, এক ডাকে মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেলেন মমতার নৈশাহারে? তৃণমূলের অনেকেই মনে করছেন, এর পিছনে দু’তরফেরই আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর তাই গত কয়েক মাস ধরে সলতে পাকানোর কাজটি হচ্ছিল নিঃশব্দে।

এটা ঠিকই যে মুকুলের দিক থেকে প্রাথমিক ভাবে প্রবল চেষ্টা ছিল বিজেপিতে যাওয়ার। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেওছিলেন, ‘‘নভেম্বর বিপ্লবের মাস। দেখুন না, কী হয়!’’ নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বরের শীত এসে গেল, মুকুল সম্পর্কে বিজেপির শৈত্য কিন্তু কাটল না। বিজেপি সূত্রের মতে, দলের একটা বড় অংশ মুকুলকে বিজেপি-তে নেওয়ার বিরোধিতা করে গিয়েছেন আগাগোড়া। এক সময়ের পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ (এখন সেই পদে না-থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় স্তরে তাঁর মতামত যথেষ্টই গুরুত্ব পেয়ে থাকে) কলকাতায় স্লোগান তুলেছিলেন ‘ভাগ মুকুল ভাগ’। সেই তাঁর বা তাঁর মতো অনেক নেতার কাছেই মুকুলকে দলে নেওয়া কোনও ভাবেই সম্ভবপর নয়। বিজেপির এই অংশের বক্তব্য, মমতা এবং মুকুল প্রকৃতপক্ষে আলাদা শিবির নন। তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে।

পাশাপাশি কংগ্রেসেও যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না মুকুলের পক্ষে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য ছিল, সারদা কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্ত হিসেবে মুকুলকেই তাঁরা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এসেছেন। তাঁকে কী ভাবে কংগ্রেসে নেওয়া যায়? দুর্নীতির প্রশ্নে অভিযুক্ত মুকুলকে কোনও ভাবে সমর্থন করার প্রশ্ন ওঠেনি বাম দলগুলির পক্ষে। এর পরই মুকুল নিজেই পিছনে থেকে নতুন একটি দল গড়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু কোনও বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সেই দলের জোট তৈরির সম্ভাবনাও যে ক্ষীণ, তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকী, নির্বাচন কমিশন ওই দলকে স্বীকৃতি দেবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে বলে মুকুল-ঘনিষ্ঠ শিবিরের অভিমত।

অন্য দিকে এটা ঘটনা যে মুকুলের জায়গাটা খালিই রয়ে গিয়েছে মমতার কাছে। মুকুলের সাংগঠনিক ক্ষমতা, দলের কোঁদল মেটানোর ক্ষমতা, জেলার কর্মীদের মধ্যে জনসংযোগ— এগুলি বিধানসভার ভোটের আগে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দলনেত্রীর কাছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সংগঠনের বাঁধন যে কিছুটা শিথিল হয়েছে এটা মুখে না বললেও, টের পাচ্ছেন নেত্রী। তাই প্রয়োজনটা উভয়ের দিক থেকেই ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে এমন কিছু করতে চাননি মমতা, যা মুকুলের পক্ষে সম্মানহানিকর হয়। তাই দুপুরে সেন্ট্রাল হলে নিজে থেকেই কুশল জানতে চেয়েছেন। রাতে নিজেই মুকুলকে আমন্ত্রণ করেছেন। তৃণমূল সূত্রের মতে, গোটা প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত যে হেতু বেশ কিছু দিন আগেই শুরু হয়েছে, ফলে গত কালের আমন্ত্রণটি যে আসবে, তা আগে থেকেই জানতেন মুকুল। তিনিও সাড়া দিয়েছেন নিঃসংশয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE