বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো!
ডাক্তারির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে স্বচ্ছ পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে ইতিমধ্যেই একাধিক পদক্ষেপ করেছে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তার পরেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা! সম্প্রতি এমবিবিএস প্রথম প্রফেশনালের ফিজ়িয়োলজি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তুলেছেন খোদ চিকিৎসকেরাই।
কড়া পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার মধ্যেও ফাঁক থাকার কথা স্বীকার করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চিকিৎসক মুকুল ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করে পরীক্ষা কক্ষে পৌঁছনোর পথে কোথাও কিছু একটা ঘটছে। ওই জায়গাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’ প্রশ্নপত্র ফাঁসে বিস্মিত পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক-আধিকারিকরাও। তাঁরা বলছেন, ‘‘নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থায় আগের থেকে পরিস্থিতি অনেকটা বদল হলেও, ১০০ শতাংশ সাফল্য এসেছে তা বলা যাচ্ছে না।’’ তাঁদের বক্তব্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে উত্তরপত্র তৈরি হয়ে ছড়িয়ে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে চ্যাট-জিপিটির মতো প্রযুক্তির ব্যবহার।
গত ১৩ অক্টোবর ছিল এমবিবিএস প্রথম প্রফেশনালের ফিজ়িয়োলজি পরীক্ষা। ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়মমাফিক সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর দু’টোয় শেষ হয়। সূত্রের খবর, ‘এমবিবিএস ফার্স্ট প্রফ-অক্টোবর ২০২৫ এগজ়াম, ডব্লিউবিইউএইচএস অবজ়ারভারস গ্রুপ’-এ পর্যবেক্ষকেরা নিজেদের কলেজের পরীক্ষা শেষ হওয়ার বিষয়টি পোস্ট করেছিলেন। সেখানেই তাম্রলিপ্ত মেডিক্যাল কলেজের এক পর্যবেক্ষক পরীক্ষা শেষের বিষয়টি জানানোর পরক্ষণেই অভিযোগ করেন শৌচাগারে নকল উত্তরপত্র পাওয়া গিয়েছে। উত্তরপত্রটির ছবিও তিনি স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষকদের ওই গ্রুপে দিয়ে দেন। ফিজ়িয়োলজির প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ওই উত্তরপত্রের হুবহু মিল রয়েছে বলেও গ্রুপে জানান চিকিৎসকেরা। বিষয়টি রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের গ্রিভান্স রিড্রেসাল কমিটিকে দেখার জন্যও অনুরোধ করেন তাঁরা। ওই কমিটির চেয়ারম্যান চিকিৎসক সৌরভ দত্ত বলেন, ‘‘পরীক্ষা ব্যবস্থা আগের থেকে অনেক স্বচ্ছ। কিন্তু এখনও কিছু অভিযোগ আসছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানো হয়েছে। আশা করি, কড়া পদক্ষেপ হবে।’’
আর জি কর আন্দোলনের সময়েই পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকেরা। সব অভিযোগ শুনে কড়া পরীক্ষা ব্যবস্থা চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে পরীক্ষা ব্যবস্থায় একাধিক নতুন নিয়ম চালু হয়। পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষে বা সেন্টার-ইনচার্জের ইমেলে পৌঁছলেও তা খোলার জন্য নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড দেওয়া হচ্ছে। যা পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে অর্থাৎ সকাল ১০টার আগে কাজ করবে না। পুরো সিসি ক্যামেরার নজরদারিতে পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাতে নজর রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষকদের অনলাইনে খাতা দেখা এবং ওই ঘর বায়োমেট্রিক লক রাখা-সহ একাধিক নিয়ম চালু হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্তাদের দাবি, কড়া পরীক্ষা ব্যবস্থা যে কাজে লাগছে তার প্রমাণও মিলছে। এমবিবিএস সেকেন্ড প্রফেশনালে ২৫ শতাংশ পড়ুয়া সাপ্লিমেন্টারি পেয়েছেন। বছর খানেক আগেও সেটি ৫ শতাংশের বেশি হত না।
কিন্তু এতই যদি কড়াকড়ি, তা হলে গত মাসে ওই প্রশ্নপত্র ফাঁস হল কী ভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরের সন্দেহ, সকাল ১০টায় পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রশ্নপত্র খোলার পরে (ডি-কোডিং) তা ডাউনলোড করে, ফোটোকপি করা হচ্ছে। এর জন্য এক ঘণ্টা সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কোনও ভাবে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্যত্র। এবং আরও কিছু সময় নিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে উত্তরপত্র তৈরি করে তা কোনও একটা মাধ্যমকে ব্যবহার করে শৌচাগারে বা অন্যত্র পৌঁছে যাচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)