আমিই জিতলাম। তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার (আফরিন আলি) ছবি: মোহন দাস।
১৯৮০ সাল থেকে বরাবর সিপিএমের দখলে থাকা আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্র অবশেষে ছিনিয়ে নিল তৃণমূল। তৃণমূলের প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার (আফরিন আলি তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তথা গতবারের সাংসদ সিপিএমের শক্তিমোহন মালিককে হারালেন ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ১৩৫ ভোটে।, পোস্টাল ব্যলট বাদে অপরূপার প্রাপ্ত ভোট ৭,৪৮,৭৬৪, শক্তিমোহন মালিক ভোট পান ৪,০১,৯১৯।
আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ১৫,৯৫,৫৬৪। আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ আসনটি ১৯৮০ সাল থেকে বরাবর সিপিএমের দখলে। তার আগে ১৯৭১ সালে আরও একবার সিপিএমের মনোরঞ্জন হাজরা কংগ্রেসের শান্তিমোহন রায়কে ২২ হাজার ২২০ ভোটে হারিয়েছিলেন। ১৯৮০ সিপিএমের বিজয় মোদক হারিয়েছিলেন জেএনপি (জনতা) দলের প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে। ভোটের ব্যবধান ছিল ৪২ হাজার ৯৯১। এরপর ১৯৮৪ সাল থেকে সিপিএমের অনিল বসু ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা সাতবার সাংসদ নির্বাচিত হন। প্রথম দফায় কংগ্রেসের গোপালদাস নাগকে ১৪,১৬০ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও তিনবার তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস এবং তিনবার বিজেপিকে হারান। ক্রমশ জয়ের ব্যবধান বাড়তে বাড়তে ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর জয়ের ব্যবধান আজও রেকর্ড। তৃনমূল জোটের বিজেপি প্রার্থী স্বপনকুমার নন্দীকে হারিয়েছিলেন ৫,৯২,৫০২ ভোটে। অনিল বসু পেয়েছিলেন ৭,৪৪,৪৬৪টি ভোট। স্বপনকুমার নন্দী ১,৫১,৯৬২টি। ২০০৯ সালে সাংসদ পদটি তপসিলি সংরক্ষিত হওয়ায় অনিলবাবুর আর প্রার্থী হওয়া হয়নি। সিপিএমের নতুন মুখ গোঘাটের গোবিন্দপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী শম্ভুনাথ মালিককে হারান ২,১১,৫৫৮ ভোটে। ২০০৪-এ বিজেপি এবং ২০০৯-এ কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করেও আরামবাগ লোকসভা থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল তৃণমূলকে। এ বার জোট ছিল না। স্রেফ ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মানুষের রায়ের উপর ভরসা করে এই আসন দখলে নিশ্চিত ছিল তৃণমূল। বিধানসভা নির্বাচনে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রের গোঘাট এবং চন্দ্রকোনা ছাড়া সবকটি ক্ষেত্রে তৃণমূল জয়লাভ করে। এ বার লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল সাতটি বিধানসভা এলাকাতেই অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে বামেদের।
শুক্রবার সকাল ১০টা নাগাদ দ্বিতীয় রাউন্ড ভোট গণনার পরই জয় নিশ্চিত জেনে একদিকে যেমন উৎসব শুরু করে দেয় তৃণমূল, তেমনই তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডবের অভিযোগ আসতে শুরু করে। দ্বিতীয় রাউন্ডেই তৃণমূলের অপরূপা পোদ্দার (আফরিন আলি) তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের শক্তিমহন মালিকের চেয়ে ৪০,৩৬৮ ভোটে এগিয়ে যান। সেই ফল ঘোষণার পর থেকেই গণনা কেন্দ্রের চত্বর থেকে শোনা যাচ্ছিল বোমার শব্দ। গণনা কেন্দ্রের ভিতরে থাকার অনুমতি পাওয়া তৃণমূল নেতা কর্মীরা বাইরে বেরিয়ে সবুজ আবির মেখে ফের কেন্দ্রে ঢুকছিলেন। চুড়িদার পরিহিতা তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার মাঝেমধ্যেই সঙ্গে ২-৩ জনকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন গণনাকেন্দ্র থেকে। বসছিলেন গণনা কেন্দ্রের মূল ফটকের ভিতরে একটি বেঞ্চে। সেখান থেকে হাত তিরিশেক দূরে আর একটি বেঞ্চে কিছুটা মুহ্যমান সিপিএমের প্রার্থী এবং গতবারের সাংসদ শক্তিমোহন মালিক ও প্রাক্তন গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিপিএমের নিমাই মাল। পৌনে ১২টা নাগাদ একবার মিডিয়া সেলে টিভি দেখতে ঢোকেন শক্তিবাবু। ততক্ষণে তাঁর কাছে বিভিন্ন জায়গায় দলীয় কর্মীদের উপরে তৃণমূলের লোকজনের হামলার খবর আসতে শুরু করেছে।
তৃণমূল প্রার্থীর জয় যখন নিশ্চিত তখন গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে সিপিএম প্রার্থীর বক্তব্য, “নির্বাচনের দিন যে ঘটনাপ্রবাহ ছিল সেই মোতাবেকই ফল হচ্ছে। এক একটা বুথে দেখছি ওরা ৫০০ থেকে ৬০০ ভোট পেয়েছে, আর আমি পেয়েছি ২৫ থেকে ৩০টা। এই ভোট জনগণ দেননি। তৃণমূলের ছাপ্পা ভোটেই এই ফল।”
সিপিএম প্রার্থীর এহেন অভিযোগ নিয়ে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার বলেন, “৩৪ বছর ধরে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি। এই প্রথম মা-মাটির সরকার সেই সুযোগ করে দিয়েছে মানুষকে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভোট দিয়ে আমাকে জিতিয়েছেন।” এদিন তৃণমূলের সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগের প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “কোথাও কোনও সন্ত্রাস হয়েছে বলে জানা নেই। তা ছাড়া দলীয়ভাবে প্রশাসনকে বলাই আছে, যে কেউ শান্তি বিঘ্নিত করলেই দলমত নির্বিশেষে আইনি ব্যবস্থা নিতে।”
সিপিএম ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ তুললেও হার নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না বিজেপি প্রার্থী মধুসূদন বাগ-সহ বিজেপি নেতৃত্বের। সকাল থেকেই তাঁদের দেখা গিয়েছে খোস মেজাজে গণনাকেন্দ্র চত্বরে ঘুরে বেড়াতে। যদিও ফল ঘোষণার পরে বিজেপি প্রার্থী বলেন, “এ বার বুথ রক্ষা করতে পারিনি আমরা। শূন্য থেকে শুরু করে যা ভোট পেয়েছি তাতে হতাশার প্রশ্ন নেই। তবে আমি নিশ্চিত এ বার সংগঠন মজবুত হবে।”
পরাজিত কংগ্রেস প্রার্থী শম্ভুনাথ মালিক অবশ্য হাসিমুখে বলেন, “ভারতবর্ষের ইতিহাসে কংগ্রেস ছাড়া কিছু আছে নাকি? এ সব গিমিক বেশি দিনের নয়, ফের স্বমহিমায় ফিরে আসব আমরা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy