Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

গোলমাল দেখতে না পাওয়াই যেখানে গোলমাল

বুথ থেকে শ’পাঁচেক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যুবক। ভোট দিয়েছেন? ক্ষুব্ধ উত্তর এল, “কী ভোট দেব? শুনছি এক জনের হয়ে অন্য জন ভোট দিচ্ছে। বুথে গিয়ে কী হবে? উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে উদয়নারায়ণপুর সিপিএম-এর শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত ছিল। ২০১১ সালের পর তা তৃণমূলের কব্জায়।

নুরুল আবসার
উদয়নারায়ণপুর শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

বুথ থেকে শ’পাঁচেক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যুবক। ভোট দিয়েছেন? ক্ষুব্ধ উত্তর এল, “কী ভোট দেব? শুনছি এক জনের হয়ে অন্য জন ভোট দিচ্ছে। বুথে গিয়ে কী হবে?”

উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে উদয়নারায়ণপুর সিপিএম-এর শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত ছিল। ২০১১ সালের পর তা তৃণমূলের কব্জায়। ভোট করানোর ছবিটা পাল্টায়নি, উল্টে গিয়েছে। দেবীপুরের বাসিন্দারা সকাল থেকেই অভিযোগ তোলেন, দেবীপুর বোর্ড প্রাথমিক স্কুলের দু’টি বুথে ব্যাপক কারচুপি চলছে। ভোটার বুথে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভোটকর্মীরা তাঁদের আঙুলে কালি লাগিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তার পরে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের ভোট দিতে। যাঁরা রাজি হচ্ছেন না, তাঁরা ভোট যন্ত্রের কাছে পৌঁছতেই পারছেন না। তাঁদের হয়ে বোতাম টিপে দিচ্ছেন দলের কর্মীরাই।

বেলা ১২টা নাগাদ দেবীপুর স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, দু’টি বুথের সামনে মোতায়েন সশস্ত্র পুলিশ। আধাসেনা নেই। একটি বুথে প্রিজাইডিং অফিসারের উল্টো দিকের বেঞ্চে বসে তিন যুবক। প্রিজাইডিং অফিসার দাবি করলেন, তাঁরা বিভিন্ন দলের পোলিং এজেন্ট। বিরোধী দলগুলোর নালিশ, তাদের এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তা হলে ওই তিনজন কোন কোন দলের? প্রিজাইডিং অফিসার নিরুত্তর।

এই স্কুলের দুটি বুথে অনিয়মের অভিযোগ কিন্তু বারবার উঠেছে। তাতে সাড়া দিয়ে এসেছেন মাইক্রো অবজার্ভর, সেক্টর অবজার্ভর, আধাসামরিক বাহিনীও। কিন্তু কারও চোখে কোনও সমস্যা ধরা পড়েনি। প্রিজাইডিং অফিসার খাতা খুলে দেখালেন, মোট পাঁচবার নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকরা এসে ঘুরে গিয়েছেন, প্রত্যেকবারই লিখেছেন, ভোট ‘পিসফুল’।

স্থানীয় বাসিন্দারা কী বলছেন? বুথের বাইরে জটলা করছিলেন নানা বয়সী গ্রামবাসী। তাঁরা জানালেন, ছাপ্পা ভোট নিয়ে সকাল থেকে বারবার গোলমাল হয়েছে, ভোট বন্ধও হয়ে গিয়েছে। এসেছে আধাসেনা। তারা ফিরে গেলেই ফের শুরু হয়েছে এই ‘খেলা।’ কথা বলতে বলতেই বুথ থেকে ফের শোনা গেল গোলমালের শব্দ। বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোট নিয়ে বচসা বেধেছে। আধাসামরিক বাহিনীর পাঁচজন জওয়ান গাড়ি থেকে নেমে লাঠি উঁচিয়ে ছুটে গেলেন বুথের দিকে। বুথের সামনের লাইনে দাঁড়ানো কিছু লোক ছুটে সরে গেল, জওয়ানরা ফিরে এসে উঠে পড়লেন গাড়িতে। জটলার কিছু মুখ মুচকি হেসে বললেন, “দেখলেন তো। এই চোর-পুলিশ খেলাই চলছে সকাল থেকে।” দেখেশুনে অনেকেই ভোট দিতে আসেননি, জানালেন তাঁরা।

উদয়নারায়ণপুরের প্রতাপচক প্রাথমিক স্কুলে রীতিমতো খাড়া রয়েছে আধাসেনা। কেমন ভোট চলছে? “সব ঠিক হ্যায়। কোই গোলমাল নেহি,” বললেন একজন। বুথের ভিতরে তখন মাদুর পেতে বসে আছেন অন্তত দশজন তরুণ-তরুণী। এঁরা কোন কোন দলের এজেন্ট, সে কথা প্রিজাইডিং অফিসার খোলসা করলেন না। “সব বড় দলের লোকই আছেন” বলে এড়িয়ে গেলেন। বুথের বাইরে অবশ্য তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের কর্মী-সমর্থককে দেখা গেল না। তাঁদের সংখ্যা বড় কম নয়। বুথ থেকে কিছু দূরে একটি গাছের নীচে জটলা করছেন শ’খানেক লোক। কয়েক জনের গলায় ঝুলছে দলীয় প্রার্থীর নাম ঝোলানো কার্ড। তা দেখিয়ে অবাধে তাঁরা বুথে ঢুকছেন। প্রিজাইডিং অফিসার কিছুই বলছেন না।

দুয়ারে আধাসেনা, তবু এখানেও ছাপ্পা ভোটে কোনও লুকোছাপা নেই। মোটরবাইকে চড়িয়ে এক বৃদ্ধাকে ভোট দিতে নিয়ে এলেন দুই তৃণমূল কর্মী। তাঁকে কোলে তুলে এক জওয়ান পৌঁছে দিলেন বুথের ভিতরে। বুথের বাইরে এক জন বেশ চেঁচিয়েই বললেন, “এই রে, ঠাকুমাকে ভিতরে তো পৌছে দেওয়া গেল। ভোটটা দেবে কে?” অন্য জনের উত্তর, “ভিতরে কাকা আছে। চিন্তা করিস না।” এই কথোপোকথন বুথের ভিতরে বসে শুনলেন প্রিজাইডিং অফিসার, ভোটকর্মীরা। শুনলেন ‘এজেন্ট’রাও। টুঁ শব্দ কেউ করলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nurul absar udaynarayanpur poll
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE