Advertisement
E-Paper

ঝগড়াকে ড্রিবল, জর্জকে ট্যাকল, তবেই না গোল

চল্লিশ ডিগ্রি গরমে গলায় জলের বোতল উপুড় করতে করতে লিলুয়ার সন্তোষ জায়সবাল বললেন, “অব কি বার, মোদী সরকার!” হাওড়া ময়দানে হার্ডঅয়্যারের দোকানে বসে প্রেম সিংহের মতামত আরও তীক্ষ্ম। “একটা মমতার দল (জায়সবাল, হাওড়া পুরসভার বাম বোর্ডের প্রাক্তন মেয়র) গিয়েছে, আর একটা মমতার দল (বন্দ্যোপাধ্যায়) এসেছে। কিছু পরিবর্তন দেখছেন? শুধু ডায়লগ আর তোলাবাজি! এ বার নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়া ভাল না?”

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩২
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, জর্জ বেকার ও শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, জর্জ বেকার ও শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

চল্লিশ ডিগ্রি গরমে গলায় জলের বোতল উপুড় করতে করতে লিলুয়ার সন্তোষ জায়সবাল বললেন, “অব কি বার, মোদী সরকার!” হাওড়া ময়দানে হার্ডঅয়্যারের দোকানে বসে প্রেম সিংহের মতামত আরও তীক্ষ্ম। “একটা মমতার দল (জায়সবাল, হাওড়া পুরসভার বাম বোর্ডের প্রাক্তন মেয়র) গিয়েছে, আর একটা মমতার দল (বন্দ্যোপাধ্যায়) এসেছে। কিছু পরিবর্তন দেখছেন? শুধু ডায়লগ আর তোলাবাজি! এ বার নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়া ভাল না?” আন্দুলের বাঙালি ব্যবসায়ী অতটা ভাঙতে চান না। রাস্তার ও’পারের পোস্টে গেরুয়া ঝান্ডার দিকে দেখিয়ে শুধু বলছেন, “এই যা দেখছেন!”

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ইদানীং বলেন, “একটা রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে চলে যাচ্ছেন মনমোহন সিংহ। আর উল্টো দিক থেকে ঢাকঢোল বাজিয়ে রে রে করে ছুটে আসছেন নরেন্দ্র মোদী!” ভোটের হাওয়া-মাখা গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের প্রাচীন জনপদ ঘুরলে মালুম হবে, ঠিকই! হাওড়ার ময়দানে সত্যি সত্যিই রে রে করে ছুটে আসছেন মোদী! এখানে তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করছেন রোদে পুড়ে গোলাপি হয়ে যাওয়া এক প্রৌঢ়! পেশায় অভিনেতা। নাম জর্জ বেকার!

হাওয়া বুঝে যথাসাধ্য গতিতে ছুটছেন জর্জ। ইস্টার সানডে’তেও বিরাম নেই। “শাসক দল ভয় পেয়েছে। আমি সবে রাজনীতিতে এসেছি। মোদীর পাশে আমার ছবির মুখেও কালি লাগিয়েছে! অনিশ্চয়তায় না ভুগলে এ সব কেউ করে?” শান্ত গলায় প্রশ্ন তুলছেন বিজেপি প্রার্থী। একই সঙ্গে চৌখশ রাজনীতিকের সুরে বলে রাখছেন, “ভয়-টয় ওরা দেখাবে। কিন্তু ভোটে লড়তে নেমেছি তো! ইট ইজ পার্ট অব দ্য গেম!”

এ ‘গেমে’র উল্টো দিকে আছেন অর্জুন-প্রাপ্ত প্রাক্তন ফুটবলার। মাত্র ১১ মাস আগে লোকসভা উপনির্বাচনে জিতে রাজনীতির মাঠ যাঁর চেনা হয়ে গিয়েছে। গত বার ময়দানে অবশ্য বিজেপি ছিল না। এ বার চেনা মাঠে গেরুয়া বাহিনীই ম্যাচটা কঠিন করে দিল না? ডাবের স্ট্র থেকে মুখ তুলে হাল্কা হাসিতে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “দিল্লি, মুম্বইয়ের মাঠে বিজেপি ম্যাচ জেতে। এখানে ৬ গোল খাবে!” তৃণমূল সাংসদের এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অবশ্য একান্তে মেনে নিচ্ছেন, উত্তর হাওড়া, বালি, মধ্য ও দক্ষিণ হাওড়ার একাংশে হিন্দিভাষী ভোটারদের মধ্যে বিজেপি-র প্রভাব কাজ করবে। আবার সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদারও (বালির বাসিন্দা, তবে শ্রীরামপুরের ভোটার) বলছেন, “দুর্ভাগ্য যে, আমাদের এখানে বিজেপি-র ভোট বাড়বে!”

বিজেপি-র একাংশে অবশ্য আক্ষেপ, হিন্দিভাষী প্রার্থী দিতে পারলে আরও জাঁদরেল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা যেত। তা-ই বলে জর্জ চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। দেশে দুর্নীতিমুক্ত সরকার গড়ার আহ্বান নিয়ে গ্রামে-শহরে চষে বেড়াচ্ছেন ‘চামেলি মেমসাহেব’-এর বার্কলে। বলছেন, “পরিবর্তন কী হয়েছে? মার্ক্সবাদী পার্টির সন্ত্রাস ছিল। পরিবর্তন হয়ে এখন যেটা চলছে, বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদ! মানুষ এখন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের দিকে আসছেন।” স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়েই হাওড়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি এবং মন্ত্রী অরূপ রায়ের বাড়িতেও প্রচারে চলে গিয়েছিলেন জর্জ!

কোন দিক থেকে ঠিক কত লোক বিজেপি-র দিকে যাবেন, আগাম হিসেব অসম্ভব। কিন্তু সিপিএমের শ্রীদীপ ভট্টাচার্য এটুকু পরিষ্কারই বলতে পারেন, উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী তুলে না-নিলে আর বালি, উত্তর হাওড়ায় বুথ দখল না-হলে ২৬ হাজার ভোটে জিতে প্রসূনের সাংসদ হওয়া হতো না! বালির পঞ্চাননতলায় হাঁটতে হাঁটতে গলদঘর্ম বাম প্রার্থী বলছিলেন, “গোলমালের চেষ্টা তো ওরা করবেই। কিন্তু গত বারের চেয়ে এ বার আমাদের কর্মীরা বেশি সক্রিয়, মানুষের সাড়াও বেশি।” প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার, সিপিআইয়ের মঞ্জুবাবু, ফরওয়ার্ড ব্লকের জগন্নাথ ভট্টাচার্যদের মিছিল যখন বালি, বেলুড়, লিলুয়া পার করছে, তাঁদের অভিবাদনের প্রতি-নমস্কার আসছে আশেপাশের বহুতল, দাঁড়িয়ে-পড়া বাস থেকে। হিন্ডালকো-র কর্মীরা মালা নিয়ে এগিয়ে আসছেন, কখনও মহিলারা বিমানবাবুদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। তিন বছরে এমন দৃশ্য দেখতে ভুলেই গিয়েছিল উত্তর হাওড়ার সিপিএম!

কিন্তু দু-একটা মিছিলে কীই বা হবে? এখনও তো বালি এলাকার প্রায় সব সিপিএম কার্যালয় বন্ধ। দক্ষিণ বালি লোকাল কমিটির সম্পাদক সমীরণ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রকাশ্যে পার্টির কাজ করা এখনও মুশকিল। তবে গত বছরের চেয়ে অবস্থা একটু ভাল হয়েছে।” মুশকিল আসান করতে একেবারে সাবেক কায়দায় চুপিসারে, দল বেঁধে হইহই না-করে তলায় তলায় মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা চালিয়েছে সিপিএম। সঙ্গে বাড়তি পাওনা, তথ্যপ্রযুক্তির নামী সংস্থায় চাকরি সামলেও কুমারদীপ রায়ের মতো নব্য প্রজন্মের দলের কাজে নেমে পড়া। কুমারদীপের দাবি, “অবাধ ভোট হলে হাওড়া এ বার বামফ্রন্টের!”

সিপিএম যখন মানুষের মৌন বিপ্লবে আশা রাখতে চাইছে, তৃণমূলের ভরসা তখন কংগ্রেস! কী ভাবে? জোট ভেঙে যাওয়ার পরে গত উপনির্বাচনে আলাদা লড়ে এবং বিশেষ প্রচারে না-থেকেই কংগ্রেসের সনাতন মুখোপাধ্যায় প্রায় ৯৬ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তৃণমূল শিবিরের আশা, প্রবল কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ায় সেই ভোট আর ‘হাতে’ থাকবে না। বিজেপি যেটুকু বাড়তি পাবে, উল্টো দিকে কংগ্রেস ভোট খুইয়ে তার সঙ্গে ভারসাম্য এনে দেবে। ফলে, গোল করে যাবেন প্রসূনই! দেওয়ালে-ব্যানারে-ফেস্টুনে কংগ্রেসের মনোজ পাণ্ডে দৃশ্যতই পিছিয়ে। তবে খাটছেন খুব। তাঁর প্রশ্ন, “আমাদের ব্যানার-পতাকা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তবে ভোট কি আগে থেকে বলা যায়? প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি বা বিক্রম সরকার হাওড়া থেকে জেতার আগে এখানে তাঁদের ভোট কত ছিল?”

সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন জেলার তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কটাক্ষ, “পায়ের তলায় জমি নেই বলে বিরোধীরা এ সব বলছেন। ওঁদের সংগঠনে লোক কম পড়লে আমরা তো আর কর্মী-সমর্থক দিতে পারি না!” সাঁকরাইল, দক্ষিণ হাওড়ার গত বারের ঘাটতি মিটিয়ে ফেলার লক্ষ্যেও জোর দিচ্ছেন রাজীব। প্রার্থী প্রসূনও তাঁর কয়েক মাসের মেয়াদে ছাড়পত্র দেওয়া একের পর এক প্রকল্পের কথা বলছেন। বহু ক্লাবের জন্য দেদার মাল্টি-জিম ‘বুক’ করেছেন। হাওড়ার কুখ্যাত রাস্তার জন্য টাকা দিয়েছেন। মোহনবাগানে যাঁর হাত ধরে গিয়েছিলেন, সেই শৈলেন মান্নার স্মৃতিরক্ষার কাজ করেছেন মনের মতো করে। সাঁতরাগাছিতে নিজের দফতর খুলে বহু সাহায্যপ্রার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। “হাওড়াকে ইউরোপ বানিয়ে দেব, এ সব বলছি না! কিন্তু পাঁচ বছরের জন্য ফিরলে কাজগুলো শেষ করা যাবে,” আশা প্রসূনের। ‘ভোকাল টনিক’ দিতে বিখ্যাত দাদা পি কে-র সঙ্গে চুনী গোস্বামীকে হাজির করে বাঙালির ফুটবল আবেগ কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও আছে।

কিন্তু সেমসাইড গোলে যদি সব ছক মাটি হয়? প্রতি এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব। কখনও প্রার্থী মঞ্চ ছাড়ার পরেই বোমাবাজি, কখনও গোলমালের আঁচ পেয়ে প্রার্থী নিজেই গরহাজির। প্রশ্নটা অবশ্য কৌশলে ড্রিবল করে প্রাক্তন ফুটবলার বলছেন, “অর্জুন পেয়েছি, দেশের ক্যাপ্টেন্সি পেয়েছি। ব্যাঙ্কে ভাল চাকরি করতাম। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় হিসেবেই আমি ভোটে লড়ছি। লোকে জানে, নিজের জন্য কিছু করতে এই লোকটা এমপি হয়নি!”এই লোকটা জিতছে তা হলে? স্থানীয় তৃণমূল নেতা বলছেন, “কেউ কেউ সাবোতাজ করতে চাইছে! কিন্তু দাদার মার্জিন বাড়বে।” আর দাদা? “ফুটবলার ছিলাম তো! শেষ বাঁশি বাজার আগে ম্যাচ ছাড়ি না!” সালকিয়ার রাস্তায় ধুলোর ঘূর্ণিতে মিলিয়ে গেল প্রাক্তন মোহনবাগানির এসইউভি!

howrah sandipan chakrabarty loksabha election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy