Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নারী নিগ্রহ, মোদী-হাওয়া ঠেকাতে ‘উন্নয়ন’-তালিকা

যশোহর রোড লাগোয়া সুকান্তনগরে এক নার্সিংহোমের সামনের দেওয়ালে অসংখ্য পোস্টার। তাতে লেখা ‘পরিবর্তনের পরিনাম, কামদুনি থেকে মধ্যমগ্রাম’! উদ্দেশ্য স্পষ্ট, গত তিন বছরে বারাসত জুড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরা। কিন্তু কেন? প্রশ্নটা শুনে ঈষৎ বিস্মিত এবং উত্তেজিত হলেন ‘ডাক্তারবাবু’। রাজারহাটে পদযাত্রা করেছেন। তার পরে নারায়ণপুরে সভা করে সবে এসে বসেছেন সুকান্তনগরের নার্সিংহোমে। এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “কেন মানে? সারা দেশের মধ্যে বারাসতেই নারী নির্যাতনের ঘটনা সব চেয়ে বেশি। এখানকার মহিলারা উদ্বিগ্ন।”

সঞ্জয় সিংহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

যশোহর রোড লাগোয়া সুকান্তনগরে এক নার্সিংহোমের সামনের দেওয়ালে অসংখ্য পোস্টার। তাতে লেখা ‘পরিবর্তনের পরিনাম, কামদুনি থেকে মধ্যমগ্রাম’! উদ্দেশ্য স্পষ্ট, গত তিন বছরে বারাসত জুড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরা। কিন্তু কেন?

প্রশ্নটা শুনে ঈষৎ বিস্মিত এবং উত্তেজিত হলেন ‘ডাক্তারবাবু’। রাজারহাটে পদযাত্রা করেছেন। তার পরে নারায়ণপুরে সভা করে সবে এসে বসেছেন সুকান্তনগরের নার্সিংহোমে। এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “কেন মানে? সারা দেশের মধ্যে বারাসতেই নারী নির্যাতনের ঘটনা সব চেয়ে বেশি। এখানকার মহিলারা উদ্বিগ্ন।” পাশে বসে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। তাঁর দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু বলেন, “আমাদের বাড়ি দেগঙ্গায়। আমাদের বড় হয়ে ওঠা, ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার আগে পর্যন্ত লেখাপড়া সবই দেগঙ্গায়। আমাদের গ্রামের বাসিন্দা মহিলা, পুরুষ, ছেলেরা সবাই একসঙ্গে বাস করেছি। কোনও দিন বারাসত, মধ্যমগ্রাম বা কামদুনির মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেনি!”

স্বাভাবিক ভাবেই ভোটে বারাসত কেন্দ্রের প্রচারে নারী-নির্যাতনকে প্রাধান্য দিয়েছেন বামফ্রন্ট মনোনীত ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী মোর্তজা হোসেন। পেশায় চিকিৎসক বলে মোর্তজাকে অনেকেই ‘ডাক্তারবাবু’ নামেই ডাকেন। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মোর্তজার দাবি, “গত তিন বছরে নারী-নির্যাতন, শাসক দলের সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ এখানকার মানুষ। তাই দলে দলে মানুষ বেরিয়ে এসে আমাদের মিছিলে সামিল হচ্ছেন।” তাঁর সহকর্মী অজিত সাউ বললেন, “হাবরা, অশোকনগর, বারাসত সর্বত্রই হচ্ছে আড়ে-বহরে বিরাট মিছিল। আর মিছিলে মহিলাদের ভিড়ই বেশি।”

ডাক্তারবাবুর কথা শুনে হেসে ফেললেন ‘ডাক্তার দিদি’। বাদুর দিগবেড়িয়ায় খুদে পড়ুয়াদের সবে কোচিং শেষ হয়েছে। মায়েদের হাত ধরে তারা বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় করছে। মায়েরা কিন্তু ডাক্তার দিদির সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। কামদুনি-মধ্যমগ্রাম কাণ্ড নিয়ে ডাক্তারবাবুর বক্তব্য শুনে ডাক্তার দিদির পাল্টা মন্তব্য, “কামদুনি তো বারাসত কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে না! ওটা বসিরহাটে। এখানকার ভোটে ওই অস্ত্রে আমাদের ঘায়েল করা যাবে না।” তার পরে ওই খুদেদের মায়েদের দেখিয়ে বললেন, “এখানকার মহিলারা শাসক দলকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হলে এঁরা কী আর আমার কাছে আসতেন?”

ডাক্তার দিদি মানে কাকলি ঘোষ দস্তিদার। গত পাঁচ বছর এলাকার সাংসদ। এ বারেও তৃণমূল প্রার্থী। তাঁর সাংসদের বেতনে বাদুর দিগবেড়িয়ায় নিজের বাড়িতে এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য কোচিং খুলেছেন। কোচিংয়ের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই সংখ্যালঘু পরিবার থেকে এসেছে। তাদের মায়েদের মধ্যে শাবানা বেগম, রিলেখা বিবি, রাজিয়া বেগমদের দেখিয়ে কাকলির দাবি, “মহিলারা কিন্তু আমাদের উপরেই আস্থা রাখে। বিশ্বাস করে।”

বারাসতে নারী নির্যাতন নিয়ে শুধু বামেরাই নয়। বিজেপি, কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা সরব এ বারের ভোটে। কাকলিদেবীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বামেদের তরফে যেমন মোর্তজা রয়েছেন, তেমনই বিজেপি-র প্রার্থী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদুকর প্রদীপচন্দ্র সরকারও (পি সি সররকার, জুনিয়র) আছেন। দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি সাময়িক ছেড়ে মধ্যগ্রামের বিজয়নগর-২ এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন প্রদীপবাবু। বাসস্থান যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনই চেহারাতেও। প্রচারে বেরিয়ে রোদে পুড়ে কালো ছোপ পড়েছে মুখে। পরনে ফৌজিদের জংলা প্যান্ট। পোলো টি-শার্ট। তার মধ্যে পাকানো সরু গোঁফে তাঁকে দেখে মনেই হবে, লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত! বিজয়নগরের বাড়িতে বসে বললেন, “আমার এই চেহারাটার জন্য গর্ব হচ্ছে! মাঠে ধান কাটতে কাটতে মানুষ যখন আমাকে দেখে হাত নাড়ছেন, আমার মনে হচ্ছে আমি সত্যি ওঁদের লোক হয়ে গিয়েছি!”

প্রচারে বেরিয়ে কথার জাদুতে তাক লাগিয়ে তিনি বলছেন, “আমি রাজনীতির লোক নই। কিন্তু মা-বোনেদের কোনও নিরাপত্তা নেই। তাই নিজের জানা সব ম্যাজিক খাটিয়ে এই অপমানজনক পরিস্থিতি একটু হলেও ভ্যানিশ করতে চাই!” বারাসতের অলিতে গলিতে মিছিল করে তিনি বলছেন, “দিল্লিতে মোদী সরকার, বারাসতে পি সি সরকার!” এলাকার মানুষ, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিশছেন সেই মিছিলে।

মহিলাদের নিরাপত্তার দাবির পাশাপাশি বারাসতে প্রতিশ্রুতি মতো মমতা-সরকার কাজ করেনি বলে অভিযোগ তুলে জোর প্রচার করছেন বিরোধীরা। মোর্তজা সাহেবের অভিযোগ, “দমদম-বারাসত মেট্রোর কাজ হয়নি। মসলন্দপুর-বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত রেল যাওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ট্রেনিং কলেজ কী হল?” সেই সঙ্গে তিনি টেনে এনেছেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদাদের মতোই সারা রাজ্যে মুসলিমদের জন্য সরকারি প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার অভিযোগও। প্রায় একই ধরনেরই অভিযোগ নিয়ে প্রচারে নেমেছেন কংগ্রেসের প্রার্থী তরুণ আইনজীবী ঋজু ঘোষালও। তবে বিরোধীদের এই সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করে দিচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী। বারাসতের উন্নয়নের জন্য তিনি গত পাঁচ বছরে কী কী কাজ করেছেন, তার ফিরিস্তি দিয়ে কাকলিদেবী রীতিমতো ৭৮ পৃষ্ঠার বই বার করেছেন! তবুও তাঁর বাড়িতে মহিলা মহলে বাদুর বাসিন্দা মমতা ঢালি প্রশ্ন করেন, “দিদি, আমাদের এখানে পানীয় জলের অভাব আছে। ড্রেনের সমস্যা আছে।’’ কাকলিদেবীর চটজলদি জবাব, “সব তিন-চার মাসে মিটে যাবে।”

সাংসদের ‘উন্নয়নের কাজে’ই এ বার জয়ের সম্পর্কে নিশ্চিত তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পর্যবেক্ষক ও রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ কী চায়? একটু ভাল রাস্তা, পানীয় জল আর ড্রেন। সবই আমরা করে দিয়েছি।’’ তার উপরে গত লোকসভার পরে বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটেও বিরোধীদের থেকে লক্ষাধিক ভোটে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। ফলে জয় নিশ্চিত বলেই মনে করেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু বা কাকলিদেবী। কিন্তু হৃদয়পুরে প্রচারে যাওয়ার আগে বারাসত স্টেশনের ধারে কংগ্রেস দফতরে বসে ঋজুর যুক্তি, “গত বার তৃণমূল ভোট পেয়েছিল প্রায় ৫১%। বিরোধী বামেরা পেয়েছিল ৩৯%। গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের জোট ছিল। তৃণমূলের সঙ্গে ছিল এসইউসি-ও। এ বার আলাদা। এমনকী, গত বার এ বারের মতো মোদী-হাওয়া ছিল না। ফলে, ভোট কাটাকাটি হবেই।’’ কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক সজল দে-ও বোঝাচ্ছেন, জোট থাকায় গত কয়েক বার কলকাতার ত্রিসীমানার মধ্যে হাত চিহ্ন নিয়ে লড়ার সুযোগই হয়নি! কিন্তু এ বার তাঁরা যেখানে সম্ভব, সেই ‘হাত’ই মানুষের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

বাম প্রার্থী মোর্তজারও দাবি, গত বার তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের যে ১১% ব্যবধান ছিল, এ বার তা থাকবে না। এ বার তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস নেই, এসইউসি-ও নেই। তার উপরে ‘মোদী-হাওয়া’য় বিজেপি-ও ভাগ বসাবে তৃণমূলের ভোটেই। ফলে, ভোট কাটাকাটির অঙ্ক ভরসা জোগাচ্ছে বামেদেরও! কিন্তু কী ভাবছেন প্রদীপবাবু? গত বার বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ৫.৪০%। কী ভাবে টপকাবেন তৃণমূলের প্রাপ্ত ৫১% ভোটের সীমা? ম্যাজিক দেখাবেন? হেসে ফেলেন জাদুকর। বলেন, “কোনও দলের এক জন সাংসদ থেকে ১৯ জন তো হয়! কী ভাবে হয়? পরিস্থিতি অনেক কিছুই বদলে দেয়!”

বিরোধীদের অবশ্য বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া দরকার। তৃতীয় দফার মতো ভোট হলে কিন্তু সব হিসাব গোলমাল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sanjay sinha barasat lok sabha election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE