Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সীমান্তের বহু গ্রামে ভোট বাড়ল বিজেপির

রাজ্য জুড়েই এ বার লোকসভায় ভোট বেড়েছে বিজেপির। উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী এলাকার বেশ কিছু বুথে তাদের সাফল্য আশাতীত। সীমান্তবর্তী এই সব গ্রামের উপর দিয়ে পাচারের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। ডাম-বাম সব আমলেই বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে নানা জিনিস পাচার হয় সীমান্তের ও পারে। বিশেষ করে গরু পাচারের জন্য এই সমস্ত এলাকার লোকজন তিতিবিরক্ত।

নির্মল বসু ও সীমান্ত মৈত্র
বসিরহাট ও বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৪ ০১:০৫
Share: Save:

রাজ্য জুড়েই এ বার লোকসভায় ভোট বেড়েছে বিজেপির। উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী এলাকার বেশ কিছু বুথে তাদের সাফল্য আশাতীত।

সীমান্তবর্তী এই সব গ্রামের উপর দিয়ে পাচারের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। ডাম-বাম সব আমলেই বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে নানা জিনিস পাচার হয় সীমান্তের ও পারে। বিশেষ করে গরু পাচারের জন্য এই সমস্ত এলাকার লোকজন তিতিবিরক্ত। গরু পাচারকারীদের একাংশ অন্য নানা অপরাধেও জড়িত। তার উপর সীমান্তের বেশির ভাগ জায়গায় কাঁটাতার না থাকায় বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের অবাধে যাতায়াত এই সব এলাকায়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সমস্যা দীর্ঘ দিনের। খুন-জখমের ঘটনা ঘটেছে নানা সময়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা গাইঘাটায় এক আরপিএফ কর্মীর বাড়িতে চড়াও হয়ে কুপিয়ে খুন করে তাঁকে। বিএসএফের উপরেও আক্রমণও নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে গুলি চালানোর ক্ষেত্রে বিএসএফ জওয়ানদের উপরে নানা নিষেধাজ্ঞার ফলে সীমান্তবর্তী এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। সেই সঙ্গে রমরমিয়ে বেড়েছে পাচার।

এই পরিস্থিতিতে সীমান্তের গ্রামে বিজেপির ভোট বাড়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের। ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা স্বীকার করছেন, পাচারের সমস্যা পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারায় কিছু ক্ষেত্রে তৃণমূলের উপরে ভরসা রাখতে পারছেন না মানুষ। সেই সুযোগে ভোটব্যাঙ্ক বাড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি। তাদের এই সব এলাকায় সাংগঠনিক প্রভাব তেমন না থাকলেও ভোটের ফল বলছে, সীমান্তের বুথগুলিতে তাদের উপরেই বেশি সংখ্যক মানুষ আস্থা রেখেছেন। সব মিলিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকার বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা এবং স্বরূপনগর বিধানসভা কেন্দ্রেই তুলনামূলক ভাবে খারাপ ফল হয়েছে তৃণমূলের। বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রেও বিজেপির থেকে প্রায় ৩০ হাজার ভোটে পিছিয়ে আছে তৃণমূল। বনগাঁ ও বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র দু’টি তৃণমূল নিজেদের দখলে রাখতে পারলেও এই প্রবণতায় অশনি সঙ্কেত দেখছেন দলের কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ।

বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে টাকি পুরসভার জালালপুর ব্যাওকাটি স্কুল। গরু পাচারের জন্য সেখানে বহু জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে বলে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ। গরু পাচার বন্ধের দাবিতে ব্যাওকাটি স্কুলের ২৫৩ নম্বর বুথে ভোট বয়কটও করেছিলেন স্থানীয় মানুষ। ভোটের দিন ফাঁকা বুথে ঢুকে কিছু দুষ্কৃতী আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ছাপ্পা ভোট মারে। তাদের মধ্যে গরু পাচারকারীরাও ছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। দুষ্কৃতীরা গোলমাল করে ফিরে যাওয়ার পরে উত্তেজিত জনতা বুথে ঢুকে ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করে। পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ওই বুথে পুনরায় ভোট গ্রহণ হয়। তখন আবার তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের এজেন্টই চোখে পড়েনি। শাসক দলকে ভোট না দিলে গ্রামছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয় বলে গ্রামের মানুষের অভিযোগ। সেই ভয়ে ভোট দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। গণনার পরে দেখা যায়, বুথটিতে তৃণমূল পেয়েছে ২৩৬টি ভোট। অন্য দিকে, বিজেপি পেয়েছে ১৭২টি ভোট। সিপিআই পায় ৬৪ এবং কংগ্রেস পায় মাত্র ৮টি ভোট।

গরু পাচার হয় যে সব এলাকার উপর দিয়ে, সেই শিবহাটি-সংগ্রামপুর পঞ্চায়েতের ৭২৯ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ১২০টি ভোট। বিজেপি সেখানে ৩৭৬টি ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ। গাছা-আখারপুর পঞ্চায়েতের ৫৩৮ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৯৯টি ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৩৫৩টি ভোট। ৬২৩ নম্বর বুথে তৃণমূল যেখানে পেয়েছে ৪০টি মাত্র ভোট, বিজেপির প্রাপ্ত ভোট সেখানে ৫২৫টি। ইটিন্ডা-পানিতর পঞ্চায়েতের ৯১৭ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৮৬টি ভোট। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৭২৬টি। এমন উদাহরণ আরও আছে। সব মিলিয়ে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে গত বার বিজেপি পেয়েছিল ৭,২৮২টি ভোট। এ বার এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ইদ্রিস আলি পেয়েছেন ৪৬,৩৫৪টি ভোট। বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যের প্রাপ্ত ভোট ৭৬,৫৭৭টি। সিপিআই প্রার্থী নুরুল হুদা আছেন তৃতীয় স্থানে। কংগ্রেস প্রার্থী কাজি আব্দুর রহিম দিলু চতুর্থ। টাকি পুরসভা এলাকায় প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে বিজেপি আছে প্রথম স্থানে।

তৃণমূলের জেলা নেতা শিবু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সীমান্তে অবাধে গরু পাচার মানুষ মেনে নিতে পারছে না। বিষয়টির মোকাবিলা করা দরকার।” একই সঙ্গে তাঁর আশা, আগামী নির্বাচনে এ সব সমস্যা কাটিয়ে উঠবে তৃণমূল।

অন্য দিকে, বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের যে সব জায়গায় পাচারের সমস্যা আচে, সেখানেও একই চিত্র। বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা এবং স্বরূপনগর বিধানসভার অন্তর্গত কানুপুর, ডুমা, ঝাউডাঙা, রামনগর, সুটিয়া, চাঁদপাড়া, কৈজুড়ি-গোবিন্দপুর, বাঁকড়া, স্বরূপনগর-ডাকবাংলো, বিথারি-হাকিমপুর-সহ বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকা দিয়ে পাচার চলে বলে অভিযোগ। বিশেষত, গরু পাচারের পরিমাণই বেশি। এই সব এলাকায় বিজেপির ফলাফল চোখে পড়ার মতো।

বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূল পেয়েছিল ২১,৮৮৯। এ বার তাদের ভোট কমে হয়েছে ১৮,৪০৬। গত বার গাইঘাটায় তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান ছিল ২৫,৪৪৭। এ বার তা কমে হয়েছে ২১,৩৯১। বনগাঁ শহরের যে সব ওয়ার্ডের উপর দিয়ে গরু নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেও ভোট কমেছে তৃণমূলের। অন্য দিকে, এই সব এলাকায় ভোটব্যাঙ্ক বাড়িয়ে নিয়েছে তৃণমূল। বনগাঁ পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডে গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি পেয়েছিল ৭৮টি ভোট। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ১৩৪৪টি ভোট। ২১ নম্বর ওয়ার্ডে তারা পেয়েছিল ৭৮টি ভোট। এ বার বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস পেয়েছেন ৮৫৩টি ভোট। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির ভোট ৭৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৪২। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ৭৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৯৮টি ভোট।

কালুপর পঞ্চায়েতের ৮৩ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ২৬৪টি ভোট। সেখানে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৪২১। এ ছাড়াও, সীমান্তবর্তী এলাকার ৭৯, ৮৯, ৯০, ৯৯ এবং ১০১ বুথে বিজেপি এগিয়ে আছে তৃণমূলের থেকে। রামনগরের ২৪৫ নম্বর বুথ, ডুমার ২০০ নম্বর বুথেও এগিয়ে বিজেপি। একই অবস্থা চাঁদপাড়া পঞ্চায়েত এলাকায়। স্বরূপনগর কেন্দ্রে গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে তৃণমূল এগিয়ে ছিল ৭৪১৪ ভোট। এ বার সেখানে বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে প্রায় ৪ হাজার ভোটে।

তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছেন, গরু এবং অন্যান্য জিনিস পাচারের ঘটনা যে সব এলাকায় বেশি হয় এবং বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য চলে বলে অভিযোগ, সেখানেই ভোটব্যাঙ্ক বাড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি। এই সব এলাকায় বাসিন্দারা সারা বছর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। চাষিদের ফসল নষ্ট হয়। মহিলাদের সম্মানহানির মতো ঘটনা আকছার ঘটে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে গত বারের তুলনায় গাইঘাটায় এবং বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রে ৪০,১২৮ এবং ৩৭৯৭৪টি ভোট পেয়েছে বিজেপি। যা গত বারের তুলনায় বেশ কয়েক গুণ বেশি।

বনগাঁ দক্ষিণ এবং গাইঘাটার সীমান্তবর্তী এলাকায় গরুপাচার ভোটে প্রভাব ফেলেছে বলে মেনে নিয়েছেন গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা ধ্যানেশ নারায়ণ গুহ। পাশাপাশি তিনি বলেন, “গরু পাচারের বিরুদ্ধে আমরা দলীয় ভাবে প্রতিবাদ করছি।”

অন্য দিকে, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পপরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে আমাদের দল এত কম ভোট পেল কেন, তা পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে জমির ফসল মাড়িয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার চাষিরা কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না। আমরাও প্রতিবাদ করছি।” প্রশাসন এবং বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করে কী ভাবে গরু পাচার রোখা যায়, দতার সমাধান সূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu simanta moitro basirhat bangaon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE