অতিরিক্ত বৃষ্টি কী আগে হয়নি! কত বারই তো হয়েছে। প্রকৃতির নিয়মে সেটাই স্বাভাবিক। তিনশো মিলিমিটারের কাছাকাছি বৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্নটা হল, বেশি বৃষ্টি হলেই এ ভাবে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমে আসবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই— আমাদের অপকর্মের জন্য।
১৯৬৮ সালে জলপাইগুড়িতে বিধ্বংসী বন্যা হয়েছিল এই সময়েই। সে দিন ছিল ৪ অক্টোবর। তার পরে ১৯৯৩ সালে ডুয়ার্সে সেই প্রলয় ডাকা বৃষ্টি এবং তার ফলে হওয়া বন্যা। সেই বন্যা মধ্য এবং পূর্ব ডুয়ার্সের ভূগোলই বদলে দিল। সেই সব বিপর্যয়ের থেকে কি বেশি বৃষ্টি হল গত শনিবার রাতে? না আমরাই দুর্যোগকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলাম সাদরে! ভাবতে হবে! এখন না ভাবলে, পরে সময় কম পড়তে পারে!
তিনশো মিলিমিটারের কাছাকাছি পরিমাণে বৃষ্টি হওয়া মানেই কিন্তু বিপর্যয় নয়। কিন্তু সেই বৃষ্টির জল বেরিয়ে যাওয়ার পথ না পেলে ডেকে আনবে বিপর্যয়। আমাদের উত্তরবঙ্গের নদীগুলি নাব্যতা হারিয়েছে। ডুয়ার্সের নদীগুলি শুকিয়ে করুণ চেহারায় পড়ে থাকে, দিনে-দিনে নদী হারাতে থাকে জলবহন ক্ষমতা। আমাদের পাহাড়ি ঝোরার মুখ বন্ধ করে তৈরি হয় বাড়ি, ঘর-সহ অজস্র নির্মাণ। পাহাড়ি নদীর মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে শুষে নেওয়া হয় জলের ধারা। তার ফলে, বৃষ্টি একটু বেশি হলেই সমতলে নদী উপচে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে জনপদ। পাহাড়ে বন্ধ ঝোরা প্রবল জলের চাপ নিয়ে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে ধসে নেমে আসবে নীচে। এ ক্ষেত্রে তেমনই হল।
উত্তরবঙ্গ এক ভঙ্গুর ইকো-সিস্টেম নিয়ে রয়েছে। হিমালয় এখনও নবীন। গাছ কাটা, পাহাড় খুঁড়ে দেওয়া মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। মাটি নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। বেশ ক’দিন ধরেই বৃষ্টি চলছিল, মাটি ভিজে ছিল। তার উপরে বেশি বৃষ্টি হওয়াতে মাটি জল ধরে রাখতে পারেনি, ধসে পড়েছে। প্রাণ কেড়েছে। দুধিয়া সেতু ভেঙেছে। দুধিয়া নদীর প্রায় উপরেই বাড়িঘর তৈরি হয়েছে, আমরা সে সবই দেখেছি, কিন্তু কিছু করিনি। তাই বিপর্যয়কে আমরা ডেকেই এনেছি। সারা বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। কলকাতা শহরও এ বছরের মতো ধারাবাহিক ভাবে এত পরিমাণে বৃষ্টিপাত বহু বছর দেখেনি। এমন মাত্রার বৃষ্টি আরও হবে, এর থেকে বেশি পরিমাণে হবে। তখন কিন্তু প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে উতরে যাওয়া যাবে না, মূল্য চোকাতে হবে। সেই মর্মান্তিক পরিণতি এড়াতে আমাদের উত্তরবঙ্গে মাটির সহনশীলতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, রক্ষা করতে হবে। উত্তরবঙ্গের নদীগুলির নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সর্বতোভাবে পদক্ষেপ করতে হবে। তা ছাড়া বিকল্প পথ আমাদের সামনে নেই।
লেখক: পরিবেশকর্মী ও ন্যাফ-এর কো-অর্ডিনেটর
অনুলিখন: অনির্বাণ রায়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)