E-Paper

মমতার হাতে কি ‘ভেট’ যাচ্ছে, ধন্দ বিজেপিতেও

বিজেপি-শাসিত একের এক রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্থার ঘটনায় প্রতিবাদের পথে নেমে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা।

সন্দীপন চক্রবর্তী, অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৫ ০৯:৩২
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রাজ্যে প্রায় ১৫ বছরের সরকার। সেই সরকারের আমলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের বেহাল দশার পাশাপাশি দুর্নীতি, অপশাসনের ভূরি ভূরি অভিযোগ। অথচ সে সব কিছু নিয়ে তীব্র আন্দোলন নেই। বরং, তারা ‘বাংলা-বিরোধী’ নয়, এই কথা বোঝাতেই প্রতিদিন সওয়াল করতে হচ্ছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলকে! বাংলায় বিধানসভা ভোটের অদূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের দলের কাণ্ড-কারখানাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও এক বার সরকার সরকার গড়ার রাস্তা প্রশস্ত করে দিচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন এবং ক্ষোভ দানা বাঁধছে বিজেপি শিবিরের অন্দরে।

বিজেপি-শাসিত একের এক রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্থার ঘটনায় প্রতিবাদের পথে নেমে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। বাংলায় ‘ভাযা-আন্দোলনে’রও ডাক দিয়েছেন তিনি। রাজ্যের অন্য দুই বিরোধী দল সিপিএম এবং কংগ্রেসও ময়দানে নেমেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায় বিজেপি নেতৃত্ব পাল্টা সওয়াল করে গিয়েছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী এবং রোহিঙ্গাদের ধরতেই নানা রাজ্যে অভিযান চলছে। এর সঙ্গে বাঙালির উপরে আক্রমণের সম্পর্ক নেই। এরই মধ্যে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ উল্লেখ করে দিল্লি পুলিশের চিঠি এবং ‘বাংলা বলে সে অর্থে কোনও ভাষা নেই’ বলে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয়ের মন্তব্য বাংলায় দলকে গভীর গাড্ডায় ফেলে দিয়েছে! মমতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল তো বটেই, শিক্ষা ও সংস্কৃতি-সহ নানা জগতের লোকজন সরব হতে শুরু করেছেন। পরিস্থিতি দেখে বিজেপির এক উত্তরবঙ্গের নেতার মন্তব্য, ‘‘মনে হচ্ছে, আমরা আত্মঘাতী হয়ে তৃণমূলকে এই ভোটটা ভেট দিতে চাইছি! অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিশ্চয়ই নিতে হবে। তাই বলে এ ভাবে?’’

সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় এই ‘অস্বস্তিকর’ পরিস্থিতির কথা এসেছিল। দিল্লি পুলিশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে যে আরও অপ্রীতিকর অবস্থা টেনে আনা হচ্ছে, উঠেছিল সেই প্রসঙ্গও। আপাতত কৌশলী অবস্থান নিয়েই বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্বকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে বলে ঠিক হয়েছে।

তৃণমূল-সহ অন্যদের কড়া আক্রমণ মোকাবিলার পন্থা নিয়েও বিজেপির অন্দরে দ্বিমত রয়েছে। এলাকায় মানুষের কাছাকাছি গিয়ে যাঁদের কাজ করতে হয়, সেই নেতা-বিধায়কদের বড় অংশই মনে করছেন, ‘বাংলা ও বাঙালি’ নিয়ে অস্মিতার প্রশ্ন তাঁদের পুরোপুরি বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতি, অন্যায়ের অভিযোগের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কোনও হেস্তনেস্ত করতে না-পারায় এমনিতেই মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। দলের ওই অংশের মতে, এর পরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে মনে হচ্ছে, বিজেপির বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশায় ফেলতে চায়। বাঙালির জন্য তারা চিন্তিতই নয়। আবার বিজেপি শিবিরের অন্য অংশের মতে, বাঙালির বিপন্নতার ভাষ্য মমতা এবং বামপন্থীদের তৈরি করা। বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিলে বাংলার সাধারণ, হিন্দু বাঙালির সমর্থন পাওয়া যাবে। এই অংশই অত্যুৎসাহী হয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ‘বাংলা’ ভাষার মধ্যে নানা ফারাক ধরতে নেমে পড়েছেন!

নির্বাচনের আগে পরিমণ্ডল ঘোরালো হয়ে উঠছে বুঝে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের আপাতত ভারসাম্যের কৌশলে নজর দিতে হচ্ছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ‘‘ভাষাটা কোনও বিষয় নয়। এ পারের মানুষ যেটা বলেন, সেটা বাংলা। বাংলাদেশের লোক যেটা বলেন, সেটাও বাংলা। বিষয়টা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে। অনুপ্রবেশকারী আর শরণার্থীর তফাত মাথায় রাখতে হবে। আইনত কোনও দেশই অনুপ্রবেশকারীর পক্ষ নিতে পারে না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বাংলাদেশ তিন লক্ষের বেশি অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত নিয়েছে। ভারতীয় মুসমিদের সঙ্গে আমাদের কোনও ঝামেলা নেই।’’ আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘মালবীয় বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘বেঙ্গলি’ বলে কোনও ভাষা নেই। ‘বাংলা’ ভাষা রয়েছে। সম্ভবত বোঝার ভুল হয়েছে। তবে বাংলায় কথা বলতে পারলেই সেই বাংলাদেশিকে তৃণমূল ভোটার হিসাবে স্বাগত জানাবে, এটাও মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের লড়াই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে।’’ দিল্লি পুলিশের চিঠির পরে প্রথমে ভাষা-তত্ত্ব দিলেও পরির্তিত পরিস্থিতিতে শমীকের বক্তব্য, ‘‘দিল্লি পুলিশ কী ভাবে, কেন ওই চিঠিটি বঙ্গ ভবনে পাঠাল, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।’’

দিল্লি পুলিশ ‘বাংলাদেশি ভাষা’র অনুবাদক চেয়ে বঙ্গ ভবনে চিঠি দেওয়ার পরে রাজ্য সরকারের তরফে কোনও জবাবি চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়নি, আইনি পথেও যাওয়া হয়নি। সে দিকে ইঙ্গিত করে সিপিএম ও কংগ্রেসের বক্তব্য, বিজেপির কাজকর্মের শুধু রাজনৈতিক ফায়দাই পূর্ণ মাত্রায় তুলছে মমতার দল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mamata Banerjee BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy