বছর তিরিশের বধূ কাজল দোলুই। নিজেদের নৌকো আর জাল নিয়ে বাড়ির সামনেই মৃদঙ্গভাঙা নদীতে মীন ধরেন। প্রতি মাসের বিশেষ সময়ে তাঁর গায়ে চুলকানি হয়, সারা শরীর ফুলে যায়।
আর এক বধূ প্রতিমা দাসের জরায়ুতে বারবার সংক্রমণ হচ্ছিল। অস্ত্রোপচার করে তা বাদ দিতে হয়েছে। ইনিও নদীতে মাছ ও মীন ধরেন। আগমনী জানা নামে আরও এক বধূর তাঁর গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইনিও মাঝে মাঝে নদীতে যান জীবিকা নির্বাহে।
যৌনাঙ্গে বা জরায়ুতে সংক্রমণজনিত এমনই নানা সমস্যায় ভুগে জীবনে এঁদের অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার বধূ নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটে। সমাজকর্মী শম্পা গোস্বামী বলেন, “স্বর্ণজয়ন্তী স্বরোজগার যোজনায় যুক্ত মহিলারা মাস কয়েক আগে মহবতনগর গ্রামে এ বিষয়ে একটি স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও সচেতনতা শিবির করেছিলেন। সেখানে তাঁরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, রজস্বলা হওয়ার সময় মহিলারা যেন পুকুরে ও নদীতে স্নান না করেন। সেই সঙ্গে ব্যবহার করেন জীবানুমুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন। আমিও একসময় এই অসুখে ভুক্তভোগী ছিলাম। এখন সচেতন হয়ে সুস্থ আছি।” বধূ আল্পনা কামিল্যারও একই বক্তব্য।
মথুরাপুর ২ ব্লকের নন্দকুমারপুর পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম মধুসূদনচক। স্থানীয় প্রধান মুজিবর রহমান খান বলেন, “গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র। নদী পুকুর আর চাষজমিই তাঁদের জীবিকা ক্ষেত্র। পরিবারগুলির আর্থিক অবস্থা ভালো নয় বলেই বিশেষত মহিলাদের জীবনযাত্রায় সেই সচেতনতা আসেনি।” গ্রামেরই বাসিন্দা দুই আশা কর্মী তাপসী জানা, গৌরী দলাই জানান, তাঁরাও একসময় রজস্বলা হলে পুরনো ধ্যানধারণা ও মা কাকিমাদের দেখিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা মেনে পুরনো কাপড় ব্যবহার করতেন। পুকুরের জলে ধুয়ে বাড়ির কোথাও লুকিয়ে রেখে শুকিয়ে ফের ব্যবহার করতেন। তাতে হয়তো রোদ পর্যন্ত লাগতো না। জীবাণু থেকেই যেত। তাপসী বলেন, ‘‘এখন চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কাজ করে ও প্রশিক্ষণ নিয়ে সচেতন হয়েছি। গ্রামের মহিলাদের সচেতন করাই। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশই সেই পুরনো ব্যবস্থায় পড়ে রয়েছেন।” গ্রামেরই বাসিন্দা ঝাড়েশ্বর মেইকাপ হাতুড়ে চিকিৎসক হিসাবে অধিকাংশ মহিলার চিকিৎসা করেন। তিনি বলেন, “প্রতিটি মহিলাকে পইপই করে বলি এই ভাবে চললে ছোটো খাটো স্ত্রীরোগ ছেড়ে যাবে না। সন্তান উৎপাদনে অক্ষমও হয়ে পড়তে পারেন মেয়েরা। আলসার থেকে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ৯৫ শতাংশই কথা শোনেন না।”
পরিবারের কারও না কারও এই ধরনের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হয় পুরুষদের। সমস্যাগুলি নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করতেন। সেখান থেকেই ন্যাপকিন বিলির বিষয়টি তাঁদের মাথায় আসে বলে জানান মধুসূদনচকের নারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘের সভাপতি অলক জানা। রবিবার তাঁরাই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মঞ্চ বেঁধে গ্রামের প্রায় ন’শো মহিলার হাতে তুলে দিয়েছেন এক বছরের প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন। চিকিৎসক এনে করছেন সচেতনতা শিবিরও। আর এ সবের জন্য অর্থ সহযোগিতা করেছে একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থার রানাঘাট শাখা। অলকবাবু বলেন, “আমরা নিজেরা এবং গ্রামের সচেতন মহিলারা যৌথভাবে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছি। তাতে যে ছবি ধরা পড়েছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের। গ্রামে ৪৭৫টি পরিবার। প্রতিটি পরিবারে একাধিক জন কোনও না কোনও সমস্যার মধ্যে রয়েছেন।” তিনি জানান, ইতিমধ্যেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রতি বছর একেকটি গ্রামে এ ভাবেই তাঁরা ন্যাপকিন বিলি করবেন। গ্রামে রয়েছে ২৭টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামেই ন্যাপকিন তৈরি করিয়ে স্বল্প মূল্যে মেয়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। স্থানীয় উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী সন্ধ্যা পড়ুয়া বলেন, “আমরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি এই ভাবেই। তবে সরকারি ভাবে এই ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত।”
রায়দিঘি গ্রামীণ হাসপাতালের আধিকারিক প্রণবেশ হালদার বলেন, “ওই বিশেষ সময়ে সচেতন না থেকে নোংরা কাপড় ব্যবহার করলে বা নদী পুকুরের জল থেকে ছত্রাক ও ব্যাকটিরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যার ফলে সাদা স্রাব, জরায়ুতে আলসার এমনকী ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ফ্যালোপিয়ান টিউব কুঁচকে যায়, ডিম্বাশয়েরও ক্ষতি হয়। যা থেকে সন্তানধারণের ক্ষেত্রে অক্ষমতাও আসতে পারে।”
তাঁর দাবি, সরকারিভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বা চিকিৎসকেরা এ বিষয়ে মহিলাদের সচেতন করেন। কিন্তু সব মহিলাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করার মতো সরকারি কোনোও প্রকল্প নেই। রায়দিঘিতে থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা করছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শিবসুন্দর সরকার। তাঁর অভিজ্ঞতায় এই ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেক মহিলাই আসেন। তিনি বলেন, “দেখা গিয়েছে সচেতন না থাকা মহিলাদের ক্ষেত্রেই এই রোগগুলির প্রভাব অনেক বেশি। চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পরও অনেকে পুরনো ব্যবস্থায় থেকে যান। যার ফলে ফের একই রোগ থেকে বড় ধরনের সমস্যা হয়।”
ওই সেবা প্রতিষ্ঠানের রানাঘাট পশ্চিম শাখার সম্পাদক সুব্রত ঘোষ বলেন, “আমরা নানা সমীক্ষা করে ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করার ফলে কত সমস্যা হয়। তাই আমাদের লক্ষ্য প্রত্যন্ত গ্রামে ন্যাপকিন বিলি করার সঙ্গে মহিলাদের সচেতন করা।”