Advertisement
E-Paper

বিহুর তালে উড়ছে হিংসার বিরুদ্ধে পতাকা

ইতিহাসের অনাদি তাতা থৈথৈ। উড়ছে হিংসার বিরুদ্ধে পতাকা। ওজাপালি কীর্তনে অসমিয়া গায়কের সঙ্গে মন মেলাচ্ছেন প্রবাসী বাঙালিরা।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:১৮
নয়াদিল্লিতে ‘সমন্বয়’-এর পুজো। নিজস্ব চিত্র

নয়াদিল্লিতে ‘সমন্বয়’-এর পুজো। নিজস্ব চিত্র

এ পুজোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকে উর্বরতার বর্ণ। এ পুজোর ছন্দে আবহমান নৃগোষ্ঠীর শস্যফলনের নাচের তাল। এই পুজোর আবাহনে ওজাপালি লোকনাট্যের পদ্মপুরাণের পদ, হাতে কাঙ্ক্ষিত মুদ্রা।

সর্বোপরি অসম এবং বাংলার যৌথ নিঃশ্বাস পশ্চিম দিল্লির রোহিণী অঞ্চলের ‘সমন্বয়’ দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। সেখানে বহরমপুরের বাতাসে মিশে গিয়েছে বরাক উপত্যকার বাষ্প।

অতএব প্রবাসই মেলাল, এদের মেলাল! কোমরে গামোচা (গামছা) বেঁধে সবুজ অসম সিল্ক আর লাল ব্লাউজে একে অন্যের কোমর জড়িয়ে এক-দুই-তিন পদপাত বড়ই ছন্দময়। ডেকা’র হাত জড়িয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোমর, মিত্র বেঁধে বেঁধে রয়েছেন শইকিয়াকে। বিহুর তালে নাচছে

ইতিহাসের অনাদি তাতা থৈথৈ। উড়ছে হিংসার বিরুদ্ধে পতাকা। ওজাপালি কীর্তনে অসমিয়া গায়কের সঙ্গে মন মেলাচ্ছেন প্রবাসী বাঙালিরা। ফি পুজোয় শুধু মহিষাসুরই তো নন, জাতিসত্তার বিভেদ আর হিংসাকেও তো নিশানা করছেন মা। সনাতন দুর্গা মূর্তি গড়ায় অভ্যস্ত দিল্লির বঙ্গ কুমোর এই যে এক গাল হেসে, দিব্য বানিয়ে ফেললেন কিছুটা মঙ্গোলীয় ধাঁচের মাতৃমূর্তি, তাতে বোধনের রোদ্দুর লেগে রইল!

এই মণ্ডপে সারাদিন গুনগুন করেন ভূপেন হাজরিকা, বিষ্ণুপ্রসাদ রাধা, জ্যোতি প্রসাদ আগরওয়ালা (যাঁর জন্মদিন অসমে পালন করা হয় শিল্পী দিবস হিসাবে)। ‘বিস্তীর্ণ দুপার’র অহংখ্য মানুহের হাহাকার হুনি নিঃহব্দ নীরব’ যে যমুনা এখনও বয়ে যাচ্ছে, তার জলও কি ইদানীং ধর্মের বিভেদে ঘোলা নয়? সেখানে এক টুকরো সম্প্রীতি, হলই বা তা পাঁচ দিনের, যমুনার দূষিত বাতাসকে এক বিরল স্পর্ধা এনে দেয়।

আর শুধু যমুনার কালো জলকে দূষে কী হবে! ঘাঁটলে ‘বুঢ়হা লুই’ অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্রেও তো রক্তের ছোপ। অসমে কামাখ্যাকেন্দ্রিক শক্তি পুজো একদা খড়্গ ধরেছে শঙ্কর দেবের নেতৃত্বাধীন ভক্তি আন্দোলন বৈষ্ণবমতের বিরুদ্ধে। ফলে অসমের আদি হিন্দু ধর্মেও পুজোতেও ভাগের মায়ের ব্রহ্মপুত্র প্রাপ্তি ঘটেনি! এ ভাগ চলছে নিরন্তর। কিন্তু প্রবাসে দৈবের বশে, শাহি দিল্লির শরৎ আকাশে এই অসহিষ্ণুতার কোনও আঁচ নেই। দিল্লির রুক্ষ জলবায়ু আর কঠোর যাপনচর্যায় লড়াই করতে করতে প্রবাসী মন জেনে গিয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল। আর তাই প্রাচীন ধর্মযুদ্ধের সঙ্গে কোনও সংযোগ নেই বয়সে নবীন রাজধানীর অসমিয়া পুজো সংস্কৃতির। বলতে গেলে, কোনও যুদ্ধের সঙ্গেই নেই। বরং এর শিকড় রয়ে গিয়েছে নিজ রাজ্যের শিল্পের সঙ্গে। গান-কবিতা-নাচই এখানে মাতৃপূজোর প্রধান মন্ত্র। যার তোরণ তৈরি হয় খড় দিয়ে। অসমের অহঙ্কারের মতো তাতে বাঁশ এবং পাত দিয়ে বোনা অসমিয়া টুপির কাজ।

এই মন্ত্র আসলে শিকড়ের কাছে ফের যাওয়ার অদৃশ্য এক সড়ক সম্ভাবনাও বটে। অসম থেকে দিল্লিতে জীবিকার খোঁজে আসা সম্প্রদায়ের দুই বা তিন নম্বর প্রজন্ম ভাল বলতেও পারে না মাতৃভাষা। দুর্গা, পুজোর ছলে তাঁদের সেই ভাষা-বিশ্বে নিয়ে যান। দশভুজায় ফিরিয়ে দেন অসমের পোশাক, নাচ, গান, কীর্তন, খাদ্য, কবিতা, নাটক, হস্তশিল্প, এই পাঁচটি দিনে। দু’তিনমাস আগে থেকে তার মহড়ায় আত্মায় বাসা পোক্ত করে অসমিয়া সংস্কৃতি। অসম থেকে আসা পুরোহিত সংস্কৃতের পাশাপাশি মন্দ্র কণ্ঠে অসমিয়াতেও অনুবাদ করেন তা।

এই পুজো বয়সে আট বছর। বাকি আরও তিন চারটি অসমিয়া পুজোর মধ্যে‌ এটি বয়োঃকনিষ্ঠ। তবে শুধু অসমই নয়, এই পুজাগুলিকে ধারণ করে আছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরও ছ’টি রাজ্য। মেখলা পরিহিত মা নজর রাখেন তাঁর সাত সন্তানকে। টুংটাং করে ওঠে কাঁসার বোটা, লোটা, সড়াই চাকরা, দুর্গা যখন প্রসাদ পান। বাঙালি, অসমিয়া, মণিপুরি, মেঘালয়ের মানুষের পাতে পড়ে ভোগের লাবড়া, খিচুড়ি, পায়োহ, বিলালি টক, জলপাই মিঠা, আমড়ার আচার। সন্ধ্যায় কচিকাঁচারা দুলে দুলে পড়ে লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া, ভবেন্দ্রনাথ সইকিয়া, নবকান্ত বড়ুয়াদের কবিতা। তারা অসমিয়া ভাষায় বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় মাতে। অসম-নির্ভর কুইজেও। সেই কুইজ জেতার জন্য, গত এক মাস তারা মাতৃভূমির খুঁটিনাটি জেনে নেয়।

রোহিণীর এই আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ।

Durga Puja 2022 Delhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy