সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে সিবিআই তাঁকে জেরা করেছে। আর এক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি-ও দফায় দফায় তাঁর বয়ান নিয়েছে। এবং এখনও পর্যন্ত যে সব নথিপত্র তাঁর তরফে জমা পড়েছে, সেগুলো নিয়ে বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।
এ বার তাই মমতা-ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তের জাল গুটিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইডি স্থির করেছে, গোড়াতেই শুভার মুম্বই ও রায়চকের দু’টি ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করা হবে।
পাশাপাশি তাঁর সংস্থা দেবকৃপা ব্যাপার লিমিটেড নিয়ে আরও খোঁজখবর করতে ফের ডেকে পাঠানো হচ্ছে বালুরঘাটের সাংসদ অর্পিতা ঘোষকে। নোটিস পাঠিয়ে তাঁকে ১৩ ফেব্রুয়ারি সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজির হতে বলা হয়েছে। অর্পিতা অবশ্য জানিয়েছেন, আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতায় থাকতে পারবেন না।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ২০০৬-এ ‘দেবকৃপা ব্যাপার লিমিটেড’ নামে শেয়ার বিক্রির একটি সংস্থা কিনেছিলেন শুভাপ্রসন্ন। ২০১০-এ তাঁর অধীনে একটি সংবাদ চ্যানেল তৈরি হয়, যা আর চালু হয়নি। ওই চ্যানেলেরই দায়িত্বে ছিলেন নাট্যপরিচালক অর্পিতা ঘোষ। ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি পুলিশের কাছে বেতন পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ জানান। ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসে। গ্রেফতার হন সুদীপ্ত সেন।
শুভাপ্রসন্নর বয়ান মোতাবেক, ২০১২-য় সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন সাড়ে ছ’কোটি টাকায় চ্যানেল-সহ পুরো কোম্পানিটি কিনে নেন। এখন ইডি চাইছে, সেই সাড়ে ছ’কোটি টাকা শুভাপ্রসন্নর থেকে ফেরত নিতে। ইডি’র দাবি, শুভাপ্রসন্ন দাবি করেছেন, তাঁর কাছে অত টাকা নেই। সুদীপ্তের থেকে পাওয়া পুরোটাই তিনি নাকি খরচ করেছেন! এই অবস্থায় তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সাড়ে ছ’কোটি টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
টাকা উদ্ধার হয়ে গেলেই কি শুভাপ্রসন্ন তদন্তের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবেন? তদন্তকারীরা অবশ্য তেমন মনে করছেন না। তাঁদের প্রশ্ন অর্পিতা আগে কখনও কোনও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। এই কাজে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতাও ছিল না। তাঁকে কেন
মোটা টাকার বেতন দিয়ে ওই সংবাদ-চ্যানেলের মাথায় বসানো হয়েছিল? আবার যে চ্যানেল চালুই হয়নি, শুধুই খাতায়-কলমে যার অস্তিত্ব ছিল, সেটি কেনার জন্য সুদীপ্ত কেন অত টাকা দিয়েছিলেন? এখানেই গোয়েন্দারা ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ আঁচ পাচ্ছেন, যার জেরে ইডি-র চার্জশিটে চিত্রশিল্পীর বিরুদ্ধে ওই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগের উল্লেখ থাকার প্রভূত সম্ভাবনা। সিবিআই সূত্রের খবর, তাদের চার্জশিটেও শুভাপ্রসন্নের নাম থাকতে পারে।
শুভার যে দুই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হতে চলেছে, তার মূল্য কত?
সূত্রের খবর: মুম্বইয়ের পাওয়াইয়ে সাতশো বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং রায়চকে ছ’শো বর্গফুটের একটি বাংলো রয়েছে শুভার। ইডি-র অফিসারেরা জানাচ্ছেন, ওই দু’টি নিলামে ওঠালে বড় জোর দেড় কোটি টাকা মিলবে। তা হলে বাকি টাকা আসবে কোথা থেকে?
ইডি-সূত্রের ইঙ্গিত, এ জন্য শুভার যাবতীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হবে। অ্যাকাউন্টগুলো ইডি সিল করে রেখেছে। তবে তাতেও পুরো টাকা উঠবে না। তাই রাজারহাটে শুভার ‘আটর্স একর’-ও নজরে রয়েছে। যদিও শুভা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, সেটি আছে ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে। ফলে আর্টস একর বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে আইনগত সমস্যা হতে পারে। একই সমস্যা দেখা দিতে পারে সল্টলেকে শুভার নিজস্ব বাড়ির ক্ষেত্রেও, কেননা জমিটি সরকারের থেকে দীর্ঘমেয়াদি ‘লিজ’-এ নেওয়া। “তবে শেষমেশ সাড়ে ছ’কোটি উদ্ধার না হলে ওই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য আদালতের বিশেষ অনুমতি চাওয়া হবে,” জানাচ্ছেন এক ইডি-অফিসার।
শিল্পীর কী বক্তব্য? শুক্রবার শুভাপ্রসন্নর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “এ সব ঠিক কথা নয়। আপনাদের যা মনে হয় লিখুন।”
আর ইডি-র তলব প্রসঙ্গে অর্পিতা বলেন, “আমি এখনও নোটিস পাইনি। যদি আমার কাছ থেকে ইডি কোনও নথিপত্র চায়, দেখাব। এর আগেও আমার কাছ থেকে দেবকৃপার (শুভাপ্রসন্নর মালিকানাধীন সংস্থা) হিসেবপত্র চাওয়া হয়েছিল। আমি জানিয়েছিলাম, দেবকৃপার যে দফতরে আমি বসতাম, সেখানে খরচাপাতির হিসেব রাখা হতো না।”
তা হলে তৃণমূলের সাংসদ অর্পিতাকে ফের জেরা করার প্রয়োজন হল কেন? তদন্তকারীরা জানান, সম্প্রতি জেলে সুদীপ্ত সেনকে জেরা করে বেশ কিছু নতুন তথ্য হাতে পেয়েছেন ইডি’র গোয়েন্দারা। তার সূত্র ধরেই ফের অর্পিতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এক ইডি অফিসারের কথায়, “এ বার অর্পিতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-সহ বিভিন্ন নথি বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখা হবে।”
২৫ এপ্রিল অর্পিতাকে এক প্রস্ত জেরা করেন তদন্তকারীরা। তখনও সিবিআই সারদা তদন্তে নামেনি। যেহেতু অর্পিতার অভিযোগ থেকেই এত বড় কেলেঙ্কারির কথা জানাজানি হয়েছিল, তাই তাঁকে প্রাথমিক ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ইডি। তার পরে তদন্তের জাল অনেক ছড়িয়েছে। সম্প্রতি জেলে সুদীপ্তকে জেরা করার পরে কিছু নতুন তথ্য হাতে এসেছে ইডি-র গোয়েন্দাদের। সেই সঙ্গে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের সম্পত্তি সম্পর্কেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দিল্লির নয়ডা ও কাশ্মীরের গুলমার্গে তাঁর তিনটি অফিস ও একটি বাংলো যাতে হাতবদল না হতে পারে, তার বন্দোবস্ত হচ্ছে। সূত্রের দাবি, চারটি সম্পত্তির ডিড ভ্যালু ২৫ কোটি টাকার বেশি। আনুমানিক বাজারমূল্য শত কোটির উপরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy