Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কাফিলের মার খাচ্ছি, তাড়িয়ে দিল দূতাবাসও

এক সময় ভেবেছিলাম ফেরা আর হবে না। মায়ের মুখটাও দেখা হবে না। ভেবেছিলাম, ঘাস কেটে আর উট চরিয়েই জীবনটা কাটাতে হবে।

পরিবারের সঙ্গে জয়ন্ত। বুধবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

পরিবারের সঙ্গে জয়ন্ত। বুধবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

জয়ন্ত বিশ্বাস (সৌদি থেকে ফিরে)
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৭
Share: Save:

এক সময় ভেবেছিলাম ফেরা আর হবে না। মায়ের মুখটাও দেখা হবে না। ভেবেছিলাম, ঘাস কেটে আর উট চরিয়েই জীবনটা কাটাতে হবে।

আরবি ভাষায় মালিককে বলে কাফিল। আমার কাফিল ছিল নইফ ফারাজ বুকমি। বছর বত্রিশের যুবক। ওরা ছ’-সাত ভাই। প্রথম পনেরো দিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আমি নইফের ক্রীতদাস। চাকরির গল্পটা তা হলে পুরো ভাঁওতা ছিল। মনে পড়ছিল, মুনির আহমেদ নামে দিল্লির যে এজেন্টের মাধ্যমে সৌদি আরবে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিটা পেয়েছিলাম, সে কোনও নথি দেয়নি। বলেছিল, মুম্বইয়ে গিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে। তার পর কাগজপত্র মিলবে।

ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়েও মনে হয়নি, পুরোটা সাজানো। তবে কাগজপত্র পাইনি। মুম্বইয়ে বলল, সৌদি থেকে কাগজপত্র এসে পৌঁছয়নি। রিয়াধ পৌঁছলে পাওয়া যাবে। বেতন নাকি মাসে এক লক্ষ টাকা। বিদেশে চাকরি পেয়েছি বলে বাড়িতে সবাই খুবই আনন্দ করছিল। যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে জমি বেচে দিয়েছিলেন বাবা। সবাই ভেবেছিল, এ বার একটা ভাল কিছু হতে চলেছে। কে জানত, কত বড় দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করে রয়েছে!

মে-র ১৫ তারিখ রিয়াধ বিমানবন্দরে নামার পর যখন পাসপোর্ট আর মোবাইলটা নিয়ে নিল ওরা, তখনই প্রথম খটকা লেগেছিল। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে প্রায় ৮০-৯০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যাওয়া হল। ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি, ভেবেছিলাম কোনও বড় অফিস বা সাইটে পৌঁছব। কিন্তু পড়ন্ত বিকেলে গাড়ি থেকে নেমে দেখি, জায়গাটা একটা খামারবাড়ির মতো। খামারবাড়ি তো নয়, বলা উচিত উটের গোয়াল! পঞ্চাশ-ষাটটা উট আর তাদের খাওয়ার বস্তা বস্তা ঘাস। ছোট্ট একটা ক্যারাভান-লরির মধ্যে আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। আরও চার জন ছিল ওখানে। তিন জন উত্তরপ্রদেশের, এক জন ইথিওপিয়ার।

পরের দিন থেকেই কাজে লেগে যেতে হল। কাজ মানে দিনভর ঘাস ঝাড়া, সেগুলো গুদামে পৌঁছে দেওয়া, উট চরানো, তাদের খাওয়ানো...। তার উপরে আবার শেখদের অজস্র ফরমায়েশ। ছাগল জবাই করা, রান্না করা, বাসন মাজা— বাদ ছিল না কিছুই! নিজেদের বরাদ্দ বলতে ডাল-চিকেন-রুটি! মাঝে মাঝে দু’এক দিন তা-ও জুটত না। কখনও কখনও টানা চব্বিশ ঘণ্টাও কাজ করেছি। কিছু বলতে গেলেই মার। ভাষা বুঝি না কাফিলের। সবই ইশারায়। যদি ইশারা বুঝতে ভুল হয়, তা হলেও মার।

দিন পনেরো পরে হাতে-পায়ে ধরে মোবাইলটা পেলাম। প্রথমেই দিল্লির ওই এজেন্টকে ফোন করি। অত্যাচারের কথা শুনে খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘‘তাই! ওরা যে এ ভাবে কাজ করাচ্ছে, তার কোনও ছবি বা ভিডিও পাঠাতে পারবে?’’ পরের দিনই পাঠিয়ে দিলাম। সন্ধেবেলায় আবিষ্কার করলাম, আমার পাঠানো ওই ভিডিও কাফিলের হাতে চলে এসেছে! অত্যাচার বাড়ল কয়েক গুণ। আমি বুঝলাম, পরিকল্পিত ভাবেই বিক্রি করা হয়েছে আমায়। তখনও ফোনে বাড়িতে বলে চলেছি, ভাল আছি, চিন্তা কোরো না। দু’টো মাস এ ভাবেই কাটল। দেখলাম, আমি একা নই। অসংখ্য মানুষকে এ ভাবে কাজ করানো হচ্ছে। বেশির ভাগই বাংলাদেশের। আবার অনেকে ভারতীয়। বেশির ভাগই আমার মতো, প্রতারিত।

এর মধ্যে আমি রিয়াধে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমাকে বলা হয়, ‘‘চলে এসো। এখানেই থাকতে পারবে। কাগজপত্র তৈরি করে তোমায় দেশে ফিরিয়ে দেব।’’ আমার কাছে পাসপোর্ট নেই। থাকার মধ্যে আছে কুড়ি হাজার টাকা। কাফিল আন্দাজ করছিল, আমি পালাতে চাইছি। ফলে অত্যাচার আরও বাড়িয়ে দিল। খেতে দিত না। রোদে কাজ করতে করতে তেষ্টা পেলে উটের পাত্র থেকেই জল খেতে হতো। শুরু হয়ে গেল যৌন অত্যাচারও। দাঁতে দাঁত চেপে পালানোর পথ খুঁজতে থাকলাম। জুলাই মাসের ১৭ তারিখ একটা সুযোগ এল। তখন আমি দাঁত মাজছি। ঘরের বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। নেপালি চালক। তাকে বললাম, বিমানবন্দরে এক বন্ধুকে আনতে যাব, পৌঁছে দেবে? বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি করে দূতাবাসে পৌঁছে দেখি, আমার মতো আরও অনেকে আসছে-যাচ্ছে। আমায় দিয়ে একটা ফর্ম পূরণ করাল ওরা। বললাম, থাকতে দেওয়া হবে না? কিছু না বলে স্রেফ তাড়িয়ে দিল। কয়েক দিন থাকলাম বাথা নামে একটা জায়গায়, এক বাংলাদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম বাবুল। সব্জির ব্যবসা ছিল। ওঁর সঙ্গে আমিও সব্জি বিক্রি করতে লাগলাম। কিছু টাকাও হাতে এল।

এক দিন খবর পাই, দামাম নামে একটি জায়গায় নাস নামে এক ব্যক্তির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে, যারা আমার মতো প্রতারিতদের দেশে ফেরায়। খড়কুটো আঁকড়ানোর মতো করে চেপে ধরলাম নাসকে। জুলাইয়ের শেষে নাস আমায় ‘ডিপোর্টেশন সেন্টার’-এ পাঠালেন। সঙ্গে আরও ছ’সাত জন। একে একে সবাই ফিরল, আমার কিন্তু যাওয়া হল না! দিন কুড়ি পর শুনলাম, আমায় আদালতে যেতে হবে। আমার বিরুদ্ধে দশ হাজার রিয়াল (ভারতীয় মুদ্রায় এক লক্ষ আশি হাজার টাকা) চুরির অভিযোগ করেছে কাফিল।

আমায় ৯ অগস্ট গ্রেফতার করা হল। সাজা, তিন মাসের জেল। একটা কুঠুরিতে থাকতাম পনেরো জন, খাবার দিত তিন জনের মতো। আমার ফোনটা নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা সৌদির অপরাধী, তারা ফোন ব্যবহার করত। এই সময় অন্য এক জনের ফোন থেকে আমি বাড়িতে সব জানাই। তিন মাস কাটতেই অক্টোবরের শেষে কাফিল এসে ফের আমাকে নিয়ে যায়। আবার শুরু অত্যাচার। এ বার মাত্রা আরও বেশি। দিনভর কাজ, দিনভর উপোস, দিনভর মারধর। আর পারছিলাম না। ইতিমধ্যে আমার বাড়ির তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে। চাপ তৈরি হয়েছিল ভারতীয় দূতাবাসের উপরে। এক দিন কাফিলের কাছ থেকে আমায় নিয়ে গেল কয়েক জন। আহমেদ বলে এক জনের কাছে ছিলাম। পরে জেনেছিলাম, সে মুনিরের লোক। মুনিরকেও চাপ দিয়েছিল আমার বাড়ির লোক।

নভেম্বরের ১১ তারিখ ভারতীয় মিডিয়ায় আমার খবরটা বেরোয় (আনন্দবাজার পত্রিকাতেও একাধিক প্রতিবেদন বেরোয়)। তার পরেই দূতাবাস থেকে ডাক পাই। শুরু হয় ফেরার প্রস্তুতি। একটা কথা কানে আসে, ‘‘আমাদের সেটিং আছে সব কিছু।’’ সেই ‘সেটিং’-এর জেরেই বোধ হয় পরের দিন কাফিল এসে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেয়। সঙ্গে ফেরার টিকিটও। তবে এই সুযোগে আমায় আরও এক দফা মারধর করে নেয়। ১৫ তারিখ সকাল ছ’টা কুড়িতে দেশে ফেরার প্লেন। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি ফিরছি। মুম্বই হয়ে আজ সকালে কলকাতা ঢুকলাম। নিজেকে চিমটি কেটে দেখছি, সত্যি সত্যি ফিরেছি তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Saudi man
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE