বিক্ষোভ এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! দু’টো নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হলেই অবিশ্বাসে হৃৎকম্প হবে অনেকের!
বুদ্ধবাবু মানে শিল্পের পথে এগোনোর কথা বলেই যাবেন। বুদ্ধবাবু মানে নিভৃতে মিলান কুন্দেরা, সারামাগো বা মার্কেজের চর্চা করবেন। বুদ্ধবাবু মানে দলীয় আসরে নিদেনপক্ষে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সহজ, কথ্য ভঙ্গিতে নিজের মূল্যায়ন পেশ করবেন। গড়পড়তা বাঙালি এই ভাবেই চেনে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু সেই পরিচয়ে এ বার অবিশ্বাস্য চমক!
বছরকয়েক যাবৎ সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যিনি প্রায় আলিমুদ্দিনের অন্তরালেই চলে গিয়েছেন, সেই বুদ্ধবাবু এখন আবার কার্যকরী ভূমিকায়! তবে অবশ্যই মাঠে-ময়দানে নয়। চার দেওয়ালের মধ্যেই ফের নিজের মস্তিষ্ক চালনা করছেন প্রাক্তন। রাজ্য সিপিএমের বিক্ষোভ ও প্রচার সংক্রান্ত সাব কমিটির (যাকে দলীয় পরিভাষায় বলে ‘অ্যাজিট প্রোপাগান্ডা বা প্রপ কমিটি’) মাথা এখন বুদ্ধবাবু! ভাঙড়-কাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন চত্বরে সিপিএমের যে আচমকা বিক্ষোভ নিয়ে এত দিন পরে হইচই বেধেছে, তার নেপথ্যে সক্রিয় ছিল বুদ্ধবাবুর মস্তিষ্কই।
প্রশ্ন উঠবে, এত দিন পরে বর্ষীয়ান, সাহিত্যপ্রেমী নেতার হল কী! মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যিনি বণিকসভার আসরে গিয়ে বলে ফেলতে পারেন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি একটা দল করেন যারা ধর্মঘট ডাকে (পরে অবশ্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন), সেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় ৬ বছর পরে বিক্ষোভের নীল নকশা আঁকছেন! কোথাও কিছু হচ্ছে না দেখে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেলে আসা জুতোয় কি পা গলিয়ে নিলেন হতাশ প্রাক্তন?
দলে বুদ্ধ-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘ভালমানুষি অনেক হয়েছে! রাজ্যে ছেলেমেয়েদের কাজ নেই। সমাজবিরোধীদের দাপট সর্বত্র। কেবলই মিথ্যাচার চলছে। এই অবস্থায় মানুষ চান, বামপন্থীরা পথে থাকুক। শীতঘুমে নয়!’’ তাই মানুষকে সঙ্গে নিয়েই এখন পথে-ঘাটে তেঁড়েফুঁড়ে নামার সিদ্ধান্ত। এই প্রক্রিয়ায় বুদ্ধবাবুর কাজ মূলত আন্দোলনের বিষয় ধরে রূপরেখা বেঁধে দেওয়া। পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের দায়িত্ব সেই পরিকল্পনার বার্তা সংশ্লিষ্ট নেতা ও ক্ষেত্রবিশেষে জনমানসে পৌঁছে দেওয়া। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘বুদ্ধদা’র কাজটা মানসিক। বাকিটা করার জন্য অন্যেরা আছেন।’’
সিপিএম সূত্রের খবর, বাণিজ্য সম্মেলনের সময়ে ভাঙড়ের ঘটনার প্রতিবাদের সুযোগ ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না বলে যুক্তি দিয়েছিলেন বুদ্ধবাবুই। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক থেকেই সেলিমকে তাই প্রথম দিন ভাঙড়ে পাঠানো হয়। পর দিন কোচবিহারের ট্রেন থেকে নামা মাত্রই সুজন চক্রবর্তীকে বলা হয় ভাঙড়ে যেতে। সে দিনই সুজন, মানব মুখোপাধ্যায়দের নিয়ে ‘অ্যাজিট প্রপ কমিটি’র বৈঠক করেন বুদ্ধবাবু। ঠিক হয়, হইচই না করে একটা বিক্ষোভ হবে মিলন মেলা চত্বরে। যেখানে সামনে থাকবেন দলের প্রথম সারির নেতারা। পাশাপাশিই ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ছাত্র-যুব এবং কনীনিকা বসু ঘোষের নেতৃত্বে মহিলাদের প্রতিনিধিদল ভাঙড়ে পাঠানো হয়।
‘ভাঙড় সংহতি মঞ্চে’র ডাকে আজ, বুধবার আলিপুরে সমাবেশ হবে ঠিকই। কিন্তু বুদ্ধবাবুরা ঠিক করে দিয়েছেন, আগামী ৩০ জানুয়ারি ভাঙড়ের উপকণ্ঠে দলের মঞ্চেও সভা হবে। অর্থাৎ ভাঙড়ের সূত্রে পাওয়া সক্রিয়তা ধরে রাখতে চান তাঁরা।
দলের এক রাজ্য নেতা বলছেন, ‘‘ভাঙড়টা একটা উপলক্ষ। তার মানে সব সময়ে শুধু বিক্ষোভই হবে, এমন নয়। এখন থেকে নিয়মিত রাস্তায় থাকার ব্যাপারটা বুদ্ধদা’ই অনেকটা ঠিক করে দিচ্ছেন। সঙ্গে সূর্যদা তো আছেনই। শুধু চলতি মাসেই নানা জেলায় ১২টা ভিড়ে-ঠাসা সভা করে ফেলেছেন রাজ্য সম্পাদক।’’ আর স্বয়ং সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আনন্দবাজারের প্রশ্নের জবাবে সরাসরিই বলছেন, ‘‘দলটাকে একটু চাঙ্গা করতে গেলে ‘অ্যাকশন মো়ড’ ছাড়া আর পথ নেই। এটা রাজ্য স্তরে আলোচনা করেই ঠিক করা হয়েছে। দাবিটা দলের মধ্যেই ছিল।’’
বামফ্রন্ট সরকারের শেষ ১০ বছরের মূল্যায়ন করে বুদ্ধবাবুর বই, যেখানে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে তৎকালীন সরকারের কাণ্ডারীর উপাখ্যান আছে, বাজারে আসছে শীঘ্রই। সেই সময়েই নতুন ভূমিকায় মনোনিবেশ করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য কটাক্ষ করছেন, ‘‘এ তো খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন! নিজেই যিনি বাড়ি থেকে বেরোন না, তিনি দেখবেন আন্দোলন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy