আগাম জানান দেয়নি সে-ভাবে। কারণ, তেমন কোনও উপসর্গ ছিলই না। তবু এক দিন স্তন ক্যানসার ধরা পড়ল ঠাকুরপুকুরের সংযুক্তা মণ্ডলের। অস্ত্রোপচার-সহ দীর্ঘ চিকিৎসায় সেরে উঠেছেন তিনি। কিন্তু ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে তাঁর দুই মেয়ে রীতা ও নবমিতার। নিজেদের নিয়ে ভয়। তাঁদের চিন্তা, এই অসুখ এড়াবেন কী করে? আদৌ এড়াতে পারবেন তো?
নবমিতাদের মতো সমস্যায় ভুগছেন যাঁরা, রবিবার তাঁদের কথা বারবার উঠল জিডি বিড়লা সভাঘরে বেঙ্গল অঙ্কোলজি ফাউন্ডেশনের বার্ষিক আলোচনাসভায়। ক্যানসার পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে দেশে। রয়েছে চিকিৎসাও। কিন্তু শহরের তাবড় ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, চিকিৎসা নিয়ে দেশ যতটা এগোচ্ছে, পার্য় সমানুপাতে পিছিয়ে রয়েছে ক্যানসার-সচেতনতায়। কী কী করলে ক্যানসার হবে না বা কী কী করলে সহজে ধরা পড়বে ওই রোগ— তার নির্দিষ্ট গাইডলাইন বা নির্দেশিকা নেই। ক্যানসার যদি না-ও হয়, সচেতনতার জন্য শারীরিক পরীক্ষার যে-ব্যবস্থার দরকার, নেই সেটাও। তাই বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকি। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, যাঁদের ক্যানসার হয়নি, তাঁরা ঝুঁকি এড়াবেন কী ভাবে?।
ক্যানসার চিকিৎসক সোমনাথ সরকার জানান, এ দিনের অনুষ্ঠান আসলে ক্যানসার রোগীদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্য। যাঁদের ক্যানসার হয়নি। হয়তো কখনও হবেও না। কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা এক চুলও কম নয়। তা তিনি কোনও রকম নেশা করুন বা না-করুন।
সভায় ছিলেন প্রদীপ মিত্র, সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো চিকিৎসক, মডেল রুক্মিণী মৈত্র, ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল ও প্রাক্তন ফুটবলার সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সভা পরিচালনা করেন ক্যানসার শল্যচিকিৎসক ও বেঙ্গল অঙ্কোলজি ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি গৌতম মুখোপাধ্যায় এবং অভিনেতা বাদশা মৈত্র। ক্যানসারের সঙ্গে মা-বাবার দীর্ঘ লড়াইয়ের সাক্ষী বাদশা।
বর্তমানে জীবনযাত্রার দ্রুত পরিবর্তন কী ভাবে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, আলোচনায় উঠে এল সেই প্রসঙ্গ। চিকিৎসকেরা বললেন, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে কিছু কিছু পরীক্ষা করানো দরকার। যেমন একটা বয়সের পর থেকে মহিলাদের জরায়ু ক্যানসারের পরীক্ষা প্যাপস্মেয়ার ও স্তন ক্যানসারের পরীক্ষা ম্যামোগ্রাফি জরুরি। পুরুষদের ক্ষেত্রে পঞ্চাশের পরে পিএসএ (প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন) পরীক্ষা দরকার।
সভার ‘নন-মেডিক্যাল প্যানেল’ অর্থাৎ অগ্নিমিত্রা, সত্যজিৎ, রুক্মিণীদের দিক থেকে প্রশ্ন উঠল, ক্যানসার না-হলে পরীক্ষা করাব কেন? সত্যজিৎ জানিয়ে দিলেন, কোনও শারীরিক অসুবিধা না-হলে তিনি হাসপাতালে পা রাখতেই রাজি নন। অগ্নিমিত্রার কথায়, ‘‘কবে ক্যানসার হতে পারে, তা পরীক্ষা করানোর জন্য সময় আর বাজেট ধার্য করা আমজনতার পক্ষে এক রকম অসম্ভব।’’ নিয়মিত পরীক্ষা চাইলেও রুক্মিণীর চিন্তা খরচ নিয়ে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এত ব্যয়বহুল পরীক্ষা নিয়মিত করিয়ে যাওয়া কী ভাবে সম্ভব? বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে অসুখ পরীক্ষার ব্যবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগও তুললেন তিনি।
চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়র অভিজ্ঞতা, কী করব আর কী করব না, সেই দিশা খুঁজে না-পাওয়াটাই মূল সমস্যা। অনেকেই ক্যানসার থেকে বাঁচতে অঙ্গ বাদ দেওয়ার ব্যাপারে মতামত চাইছেন তাঁর কাছে। গৌতমবাবুর প্রস্তাব, এত চিন্তার কারণ নেই। সরকার যদি ক্যানসার সচেতনতা বাড়াতে আরও একটু উদ্যোগী হয়, যদি ক্যানসারের পরীক্ষা করানোর পরিষেবা পাওয়া যায় কম দামে, সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসবেন। বেসরকারি হাসপাতালের রমরমা কমবে। কমবে ঝুঁকিও।
বেশি প্রয়োজন সচেতনতার। আমজনতা সচেতন হোক। এই আর্জিই জানালেন চিকিৎসকেরা। শেষে ছিল আলিপুর জেলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অলকানন্দা রায়ের পরিচালনায় নৃত্যনাট্য ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু’। ফাউন্ডেশনের সদস্য বাদশা মৈত্র বললেন, ‘‘ক্যানসার নিয়ে লড়াইয়ের কথা যতই ইতিবাচক ভাবে খাতায়-কলমে লেখা হোক, তা মানুষকে যথেষ্ট ভরসা দিতে পারে না। যতটা পারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে মানুষকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করি আমি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy