Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দলের দিকেই তির ফরজানার পরিবারের

নিজের দলেরই অন্য গোষ্ঠীর হাতে তাঁকে নিগৃহীত হতে হয়েছিল বলে অভিযোগ। চার দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ব্যক্তিগত বন্ড দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন কলকাতা পুরসভার বিদায়ী ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলম। তৃণমলের কোনও মন্ত্রী কিংবা প্রথম সারির নেতা এ ক’দিনে একবারও দেখতে যাননি তাঁকে। এমনকী দলের যে অংশের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ এনেছিলেন, দল তাকেও মান্যতা দেয়নি। পুলিশও ধরেনি অভিযুক্ত ১৬ জনকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০৪:০৫
Share: Save:

নিজের দলেরই অন্য গোষ্ঠীর হাতে তাঁকে নিগৃহীত হতে হয়েছিল বলে অভিযোগ। চার দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ব্যক্তিগত বন্ড দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন কলকাতা পুরসভার বিদায়ী ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলম। তৃণমলের কোনও মন্ত্রী কিংবা প্রথম সারির নেতা এ ক’দিনে একবারও দেখতে যাননি তাঁকে। এমনকী দলের যে অংশের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ এনেছিলেন, দল তাকেও মান্যতা দেয়নি। পুলিশও ধরেনি অভিযুক্ত ১৬ জনকে।

সোমবার রাতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর কিন্তু হাসপাতাল এবং ফরজানার পিকনিক গার্ডেনের বাড়িতে রীতিমতো লাইন পড়ে গিয়েছে মেয়র, মন্ত্রী, নেতাদের। তাতে অবশ্য দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফরজানার অনুগামীদের ক্ষোভ মেটেনি। ফরজানা আত্মীয়দের আক্ষেপ, দল ফরজানার প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হলে বেঁচে থাকার জন্য মনের জোরটা অন্তত পেতেন তিনি। বিশেষ করে প্রয়াতা তৃণমূল নেত্রীর ১১ বছরের ছেলেটি যত বার সর্বসমক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে, দলীয় নেতৃত্বের প্রতি তত বারই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সবাই।

চিকিৎসকেরা ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিখেছেন হৃদ্‌রোগ। কিন্তু ফরজানার পরিবারের ধারণা, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই তাঁদের পরিবারের অতি প্রিয় সদস্যটির জীবন নিভে গেল। পটনার বাসিন্দা, ফরজানার বড়দা খুরশিদ আলম মঙ্গলবার সকালেই কলকাতা পৌঁছেছেন। বেসরকারি হাসপাতালে শেষ শয্যায় বোনকে দেখে বেরিয়ে এসে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওর পার্টিই ওর জানটা শেষ করে দিল।’’ খুরশিদের অভিযোগ, ‘‘এটা রাজনৈতিক খুন।’’ কেন বলছেন এ কথা? তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘একে তো ওয়ার্ড বদল, তার উপরে অন্তর্ঘাত করে ওঁকে হারানো হয়েছে। হারার পরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল বোন। কিন্তু তিনি কথা শোনেননি।’’

ফরজানার দাদার এই অভিযোগ সম্পর্কে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আবেগতাড়িত হয়ে ওঁরা এ সব বলেছেন। নির্বাচনে পরাজয়ের অবসাদ স্বাভাবিক। এর মধ্যে রাজনীতি না আনাই বাঞ্ছনীয়।’’ আর তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েই ফরজানা মারা গিয়েছেন। এই নিয়ে বিরোধীরা অযথা হইচই এবং কদর্য রাজনীতি করতে চাইছেন।’’

তবে ভোটে হারার পরও যে ফরজানা দলের নেতানেত্রীদের কাছে নানা ভাবে অপমানিত হয়েছেন, তাঁর দাদা সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে খুরশিদ বলেন, ‘‘৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মীরা আমার বোনকে মারধর করার পরেও দলের কোনও বড় নেতা-নেত্রী তাঁর খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন মনে করেননি। বোন এটা মেনে নিতে পারেনি।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও বলেন, ‘‘অসম্মানিত হওয়াটাই হয়তো তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে।’’

পুলিশের কাছে পরিবার অভিযোগ জানাবে না? খুরশিদ কিছু একটা বলছিলেন। কিন্তু সমবেত চিৎকার চেঁচামেচিতে ঢাকা পড়ে যায় তাঁর গলা। তবে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক ফরজানা অনুগামী গলা চড়িয়ে বললেন, ‘‘দিদি নিজে ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন পুলিশে। দলকেও সেই ১৬ জনের নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু দল বা পুলিশ, কেউ কিছু করেনি।’’

পুলিশ কী বলছে? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র এ দিনও দায়সারা ভাবে জানিয়েছেন, ‘‘তদন্ত হচ্ছে। আইন আইনের পথেই চলবে।’’ সোমবার রাত থেকে যে সব তৃণমূল নেতা হাসপাতালে এসেছেন, তাঁরাও একই আশ্বাস দিয়েছেন ফরজানার পরিবারকে। কিন্তু গত ১৩ দিনে কেন অভিযুক্ত এক জনকেও পুলিশ ধরতে পারল না বা কেনই বা দলের পক্ষ থেকে পুলিশকে চাপ দেওয়া হল না— সেই প্রশ্নের জবাব লালবাজার এবং তৃণমূল ভবন কেউই দেয়নি।

তবে ফরজানার প্রতি দলের ‘বঞ্চনা’ নিয়ে খোদ তৃণমূলের কাউন্সিলরদের মধ্যেই ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। এ দিন একাধিক কাউন্সিলর জানান, এ বার ২৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ফরজানাকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয় ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে গত বারের প্রার্থী ইকবাল আহমেদকে। ফরজানার বক্তব্য ছিল, ২৮ নম্বর স‌ংরক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সরানো হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়। ৩০ এপ্রিল বিরোধীদের ঢাকা ধর্মঘটের দিন ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে পাম অ্যাভিনিউয়ের পার্টি অফিসে তৃণমূলের এক দল কর্মীর হাতেই ফরজানা মার খান বলে অভিযোগ। হাসপাতাল থেকে তিনি কয়েক দিন আগেই বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু তার পরেও খুব একটা কথা বলতেন না কারও সঙ্গে। এ ভাবে গুমরে থাকাটাই কাল হল বলে মনে করছেন আলম পরিবারের অনেকে। ফরজানার বোন গুঞ্চা আলম তাই বলছিলেন, ‘‘ওরা আবির খেলুক, মিষ্টি খাক। আমাদের কষ্ট আমাদেরই থাক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE