Advertisement
E-Paper

চরম সাজা ৮ খুনির, ৪ জনের জেল

এক-এক করে আট জনের নাম পড়লেন বিচারক। একটু থামলেন। ভিড়ে ঠাসা বারাসত আদালতে তখন পিন পড়লেও যেন শোনা যাবে। তার পরে বিচারক বললেন, ‘‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় আট জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।’’

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:১১

এক-এক করে আট জনের নাম পড়লেন বিচারক। একটু থামলেন। ভিড়ে ঠাসা বারাসত আদালতে তখন পিন পড়লেও যেন শোনা যাবে। তার পরে বিচারক বললেন, ‘‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় আট জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।’’

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। হাল্কা গুঞ্জন। তার পরেই ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ আদালতকক্ষে।

কে কাঁদে?

কাঁদে বাদী ও বিবাদী। কাঁদে ফরিয়াদি আর আসামি, দু’পক্ষই। এক পক্ষের কান্না স্বজন হারানোর বিচার পাওয়ার আনন্দে। আর অন্য পক্ষ কেঁদেছে দুষ্কর্মের পরিণাম দেখে।

কাঁদছেন বামনগাছির প্রতিবাদী কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরীর মা-বাবা-দাদা। শোকের পাথরে নিজেদের আবেগ কুড়ি-কুড়ি মাস চাপা দিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। সৌরভ-হত্যায় দোষী সাব্যস্ত ১২ জনের মধ্যে আট জনেরই ফাঁসির আদেশ শুনে মঙ্গলবার সেই আবেগ সংযমের বাঁধ ভেঙে কান্না হয়ে ঝরে পড়ল। জনাকীর্ণ ন্যায়ালয়ের মধ্যেই।

কাঁদছেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আট আসামির আত্মীয়স্বজনও। কোর্ট লক-আপে মাথা ঠুকছেন কারও মা, কারও দিদি, কারও বা স্ত্রী।

কাঁদতে দেখা গেল আরও এক জনকে। সাজা ঘোষণার আগের মুহূর্তেও যে ছিল অবিচল, ভাবলেশহীন, কঠোর। যার আকাশি টি-শার্টের পিছনে লেখা— ‘ইন ফাইটার উইনার’। কিন্তু বিচারকের পড়ে শোনানো আটটি নামের মধ্যে তারও নাম। ফাঁসির আদেশ শুনে সেই শ্যামল কর্মকারও মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। কান্নায় ভেঙে পড়ল ফাঁসির আদেশ পাওয়া তার সাত সঙ্গীও।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন।

বেলা ১২টা। বারাসত আদালতের সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দামনপ্রসাদ বিশ্বাস দোষী সাব্যস্ত হওয়া ১২ জনের মধ্যে আট জনকে ফাঁসি, এক জনকে যাবজ্জীবন এবং তিন জনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। সৌরভ খুন হওয়ার ২০ মাস পরে, গত শুক্রবার বিচারক এই ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। এক অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দেন তিনি।

আসামিদের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন।

কামদুনির কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় গত জানুয়ারিতে তিন জনকে ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। আবার নদিয়ার ঘুঘরাগাছিতে জমি দখল নিয়ে এক মহিলাকে গুলি করে হত্যার মামলায় ফেব্রুয়ারিতে মূল অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ-সহ ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার পরে সৌরভ-হত্যায় আট জনকে ধরে এ বছর চার মাসে তিনটি বহুচর্চিত মামলায় মৃত্যুদণ্ড হল ২২ জনের।

বিরাটি কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌরভ তাঁর বাড়ির আশেপাশে এবং লাগোয়া এলাকায় চোলাই মদ ও সাট্টার ঠেক এবং মহিলাদের উদ্দেশে কটূক্তির প্রতিবাদ করে এক দল দুষ্কৃতীর রোষানলে পড়েন। ২০১৪ সালের ৪ জুলাই সৌরভ রাতে বাড়ি থেকে বেরোন। তার পরে আর ফেরেননি। পরের দিন সকালে বামনগাছি ও দত্তপুকুর স্টেশনের মাঝখানে রেললাইনের ধারে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায় টুকরো টুকরো অবস্থায়।

সরকারি আইনজীবী বিপ্লব রায় জানান, সৌরভ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে অভিহিত করেছেন বিচারক। এবং সেই জন্যই দোষীদের মধ্যে আট জনকে মত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কেন এই ঘটনা বিরলের
মধ্যে বিরলতম? তার পক্ষে মূলত তিনটি কারণের উল্লেখ করা হয়েছে এ দিনের রায়ে।

• কলেজছাত্র সৌরভ এবং তাঁর বন্ধুরা এলাকায় সমাজবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছিলেন। সেই জন্য প্রচণ্ড আক্রোশে সৌরভকে খুন করে শ্যামল ও তার সঙ্গীরা। আর হঠাৎ-খুন নয়, খুন করা হয় রীতিমতো ছক কষে।

• রাজসাক্ষীর বয়ানে দেখা যাচ্ছে, গলায় রুমাল পেঁচিয়ে সৌরভকে খুন করার পরে তাঁর হাত-পায়ের শিরা কেটে, গোটা দেহ ভোজালি দিয়ে খণ্ড খণ্ড করা হয়। যা চূড়ান্ত নৃশংসতার পরিচয়। তার পরে দেহের টুকরো টুকরো অংশ রেখে দেওয়া হয় রেললাইনে। যাতে মনে হয়, ট্রেনে কাটা পড়ে সৌরভের মৃত্যু হয়েছে।

• খুনের পরে ওই এলাকাতেই প্রথমে দিদির বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে তারাপীঠে পালিয়ে যায় শ্যামল। সেখানে পুজো দেয়, ভুয়ো পরিচয়পত্র জমা দেয় হোটেলে। পেশাদার খুনির মতো ছিল তার আচরণ। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে মাথার চুল আর গোঁফ কেটে ফেলে নিজের হুলিয়াও বেমালুম বদলে ফেলে শ্যামল।

সরকারি কৌঁসুলি বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ড বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা। একসঙ্গে এত জনকে ফাঁসি ও কারাদণ্ড দেওয়াটাও বিরল।’’

তবে শ্যামল-সহ দণ্ডিত কয়েক জনের আইনজীবী প্রদীপ করের দাবি, এটা আদৌ বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা নয়। ‘‘এই ধরনের খুন আগেও অনেক হয়েছে,’’ বলছেন প্রদীপবাবু। যুক্তি সাজাতে কামদুনির কলেজছাত্রী এবং ভবানীপুরের তরুণী হেতাল পারেখকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার কথা তুলেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, কামদুনি ও ভবানীপুরের ঘটনায় যে-ধরনের নৃশংসতা প্রকট হয়ে উঠেছিল, এখানে তেমনটা হয়নি। রায়ের প্রতিলিপি হাতে পাওয়ার পরে ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন বলে জানান প্রদীপবাবু।

সৌরভ-হত্যা বিরলের মধ্যে বিরলতম কি না, তার পর্যালোচনায় বাড়তি সময় নিয়েছিল আদালত। সেই জন্য ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করার পরের দিন সাজা ঘোষণা করা হয়নি। আলোড়ন ফেলে দেওয়া এই মামলায় দোষীদের কী শাস্তি হয়, সেই ব্যাপারে কৌতূহল তুঙ্গে উঠেছিল। এ দিন আদালত-চত্বর মুড়ে দেওয়া হয়েছিল পুলিশে। নামানো হয় প্রচুর র‌্যাফ। আদালতে উপস্থিত ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে জেলা পুলিশের তাবড় কর্তারা।

তন্ময়বাবু বলেন, ‘‘কম সময়ের মধ্যে চার্জশিট, দোষীদের শাস্তি— এটা গোটা টিমের কৃতিত্ব।’’ দণ্ডাদেশ শুনে সৌরভের স্বজনেরা পুলিশ সুপারের অফিসে গিয়ে ধন্যবাদ জানান। সৌরভের বাবা সরোজ চৌধুরী বলেন, ‘‘ভদ্র, নম্র, খুব ভাল ছেলে ছিল আমার সৌরভ। ওকে তো আর ফিরে পাব না। দোষীদের সাজা হওয়ায় অনেক কাল পরে আজ একটু শান্তিতে ঘুমোব।’’ আর সৌরভের দাদা সন্দীপের কৃতজ্ঞতা এলাকার সাধারণ মানুষের প্রতি। তাঁর কথায়, ‘‘ঘটনার পরে এলাকাবাসী আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা জুগিয়েছেন।’’

গত শুক্রবার, ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করার দিন সকলেরই ফাঁসি চান বলে জানিয়েছিলেন সৌরভের মা মিতাদেবী। আট আসামির ফাঁসির আদেশ শুনে এ দিন কিছু বলতে পারেননি তিনি। বড় ছেলে সন্দীপকে জড়িয়ে শুধু কেঁদেই গিয়েছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy