মৃত্যু তো মৃত্যুই। চোখ দান করলে তাড়াতাড়ি ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হবে আর চোখ না-দিলে অন্তত চার ঘণ্টা দেরিতে তা দেওয়ার ব্যবস্থা কেন? মৃত্যু-শংসাপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে দু’রকম ‘সময়’ কেন থাকবে?
কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এমনই এক প্রশ্ন তুলে ধরেছে মহানগরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের বক্তব্য, বর্তমান ব্যবস্থায় মৃতের দেহ থেকে চোখ নিলে ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’-এর এক ঘণ্টার মধ্যে ডেথ সার্টিফিকেট মেলে। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস আর কর্নিয়া অচল হয়ে গেলে সেটাকেই বলা হয় ক্লিনিক্যাল ডেথ। চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় মৃত্যুর পরমুহূর্তের অবস্থাই ক্লিনিক্যাল ডেথ। আর অন্য ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট মেলে ‘মলিকিউলার ডেথ’-এর পরে। এবং মৃত্যুর অন্তত চার ঘণ্টা পরে বলা হয়, মলিকিউলার ডেথ হয়েছে। এর অর্থ দেহের সব কোষের মৃত্যু। ডেথ সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে দু’রকম সময় থাকবে কেন?
চিকিৎসকদের কথায়, সাধারণ ভাবে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয় মলিকিউলার ডেথের পরেই। সেই হিসেবে সকাল ৬টায় যদি কারও মৃত্যু হয়, ডেথ সার্টিফিকেট মিলবে সকাল ১০টায়। তবে সরকারি বিধিতেই বলা হয়েছে, চক্ষু দানের ক্ষেত্রে সময়ের সেই ন্যূনতম চার ঘণ্টা ব্যবধান মানা হয় না। আর ধন্দটা ঠিক এখানেই।
আরও পড়ুন: ডাক্তাররাই চুপ, আটকে তদন্ত
এই ব্যাপারে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ১৮ বছর আগে রাজ্য সরকারের দেওয়া একটি নির্দেশিকার কথা বলছে। ঠিক কী বলা হয়েছে দেড় যুগ আগেকার সেই নির্দেশিকায়?
১৯৯৯ সালের ২৪ অগস্ট তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব ওই নির্দেশিকা পাঠিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে। তাতে লেখা আছে, ‘ডেথ সার্টিফিকেট ইজ ইস্যুড ইন অল কেসেস অব দ্য ডিসিজড পার্সনস হু হ্যাভ ডোনেটেড দেয়ার আইজ ….উইদিন ওয়ান আওয়ার আফটার দ্য ক্লিনিক্যাল ডেথ।’ অর্থাৎ মৃতের চোখ দানের ক্ষেত্রে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকায় ‘চার ঘণ্টা’র সেই ব্যবধান কমানোর কথা বলা হয়েছে। যাঁর চোখ সংগ্রহ করা হবে, তাঁর ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ডেথের এক ঘণ্টার মধ্যে সার্টিফিকেট দিতে হবে। মলিকিউলার ডেথ ঘোষণার আগেই। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, তা না-হলে মৃতের চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই চোখ কোনও জীবিত মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর কাজে লাগতে পারে। তাই তা দ্রুত সংগ্রহ করা দরকার। রাজ্যের প্রতিটি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নোটিস পাঠিয়ে এই বিধি মানতে বলা হয়।
এখন প্রশ্ন, মৃত্যু নিশ্চিত হলে তবেই তো চোখ নেওয়া যেতে পারে। চোখ দানের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ডেথ যদি মৃত্যু সম্পর্কে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়ার কথা বলে, অন্য ক্ষেত্রে আরও তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার কারণ কী? কেউ চোখ দান করুন বা না-করুন, ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার সময়টা আলাদা হবে কেন?
সংস্থার এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি পুরকর্তারা। তাঁরা জানান, বিতর্ক মেটাতে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের শরণাপন্ন হচ্ছে পুরসভা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান বিশ্বজিৎ শুকুলের কথায়, ‘‘চোখ দানের ক্ষেত্রে কর্নিয়ার কথা ভেবে ক্লিনিক্যাল ডেথের পরেই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। তা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই। তাই চোখ যদি না-ও দেওয়া হয়, সে-ক্ষেত্রেও ক্লিনিক্যাল ডেথের পরে সার্টিফিকেট কেন মিলবে না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।’’ এর একটা সর্বসম্মত সমাধান বার করা দরকার বলে জানান কিছু সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও।
‘‘প্রশ্ন উঠেছে জানি। তবে ক্লিনিক্যাল ডেথের চার ঘণ্টা পরে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার নিয়ম থেকে এখনই সরছে না স্বাস্থ্য দফতর,’’ বললেন ওই দফতরের এক কর্তা। তাঁর ব্যাখায়, চোখ দানের ক্ষেত্রে দেরি হলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে সময় কমানো হয়েছে। অঙ্গদানের কিছু কিছু ক্ষেত্রেও তা করা হবে। তবে ‘বিশেষ’ ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণ ভাবে সময়ের নিয়ম শিথিল করার কোনও প্রশ্নই নেই। যদিও স্বাস্থ্যকর্তার এই ব্যাখ্যা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মানতে রাজি নন অনেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy