Advertisement
E-Paper

ফিরিয়ে নেয়নি ঘর, পাড়াই তাঁর আত্মীয়

বাড়িতে তাঁর ঠাঁই হল না। কিন্তু আশ্রয় বিছিয়ে দিল গোটা পাড়া। ৫০ বছরে পৌঁছে সুপ্রিয় সাধুখাঁ বুঝলেন, শুধু রক্তের সম্পর্কেই আত্মীয় হয় না।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৮
বৈদ্যবাটিতে নতুন ঠিকানায় সুপ্রিয় সাধুখাঁ। প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

বৈদ্যবাটিতে নতুন ঠিকানায় সুপ্রিয় সাধুখাঁ। প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

বাড়িতে তাঁর ঠাঁই হল না। কিন্তু আশ্রয় বিছিয়ে দিল গোটা পাড়া। ৫০ বছরে পৌঁছে সুপ্রিয় সাধুখাঁ বুঝলেন, শুধু রক্তের সম্পর্কেই আত্মীয় হয় না।

টানা এক যুগ তাঁর কেটেছে কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। তার মধ্যে শেষের কয়েক বছর সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায়। হাসপাতালের তরফে বারবার তাঁর বাড়িতে চিঠি গিয়েছে। উত্তর আসেনি। অথচ প্রত্যেকটা মুহূর্ত বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে থেকেছেন সুপ্রিয়বাবু।

শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছিলেন। এ বার দুর্গাপুজোর আগে প্রবল জ্বর হয় তাঁর। ডেঙ্গি সন্দেহ করে লুম্বিনী কর্তৃপক্ষ সুপ্রিয়বাবুকে ভর্তি করেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকেই এক দিন কাউকে কিচ্ছু না বলে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কয়েক ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছন হাওড়া স্টেশনে। তার পর বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপে ষষ্ঠীর সকালে পৌঁছন হুগলির বৈদ্যবাটিতে নিজের বাড়িতে। যেখানে এখন থাকেন তাঁর মা, এক বোন-ভগ্নিপতি এবং আর এক অবিবাহিতা বোন।

বাড়িতে ঢুকতে যান সুপ্রিয়বাবু। আর ঢুকতে গিয়েই প্রায় ঘাড়ধাক্কা খান। অভিযোগ, মারমুখী ‘আপনজনেরাই’ পত্রপাঠ তাঁকে বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসেন একদল পড়শি। এই ‘অনাত্মীয়’রাই চেঁচামেচি শুরু করেন— কেন বাড়ির ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না?

পাড়ার চাপ বাড়তে থাকায় শেষ পর্ষন্ত রাতের দিকে, কাছেই একটা ছোট, ভাঙা ঘরে সুপ্রিয়বাবুকে থাকতে দেন তাঁর ভগ্নিপতি দিলীপ লাল। কিন্তু জানিয়ে দেন, আর বিশেষ কোনও দায়িত্ব তাঁরা নিতে পারবেন না।

মুহূর্তে পাড়া ফের এককাট্টা। পড়শিরা ঠিক করে ফেলেন, দু’টো ডালভাত আর ওষুধপত্র তাঁরাই না হয় খাওয়াবেন পালা করে। তবে তার আগে একটা সমস্যা ছিল। হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসার পরে লুম্বিনী পার্ক এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল— দুই হাসপাতালই থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিল। কাজেই নিয়ম মেনে ছুটি পেতে হলে ফের হাসপাতালে যেতেই হতো সুপ্রিয়বাবুকে। তার পর বাড়ির তরফে সইসাবুদ করে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে হতো। আশ্চর্যজনক ভাবে, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুরোধ সত্ত্বেও এ বারও সুপ্রিয়বাবুর আপনজনেরা জানিয়ে দেন, তাঁরা কিছুই করবেন না! শেষ পর্যন্ত সেই পাড়ার লোকেরাই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ‘আত্মীয়’ হিসেবে সইটই করে আবার ফিরিয়ে আনেন পাড়ায়।

শুরু হয় নতুন জীবন। এক চিলতে টালির ঘরে একটা খাটের ব্যবস্থা হয়। পড়শিরা এনে দেন বেশ কয়েক সেট জামাকাপড়, বাসনপত্র। হাসপাতালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে লেখা ওষুধগুলো শুধু কিনে আনাই নয়, ঘড়ির কাঁটা মেনে খাওয়ানোও শুরু করেন। ভিটের লোকেরা তাঁর মায়া কাটালেও বাইরের পৃথিবীটাই হয়ে ওঠে সুপ্রিয়বাবুর ‘ঘর’।

শনিবার সকালে বৈদ্যবাটি ধানকলের কাছে সেই পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন সকলে। মধ্যমণি সুপ্রিয়বাবু। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে এসেছেন শুক্লা দাস বড়ুয়া এবং লিগ্যাল অফিসার অধিরাজ রায়। এসে গিয়েছেন স্থানীয় পুর প্রতিনিধি ব্রহ্মদাস মুখোপাধ্যায়ও।

পাড়ার লোকেদের অনুরোধেই কিছু পরে চলে এলেন স্থানীয় থানার অফিসারও। সু্প্রিয়বাবুকে সঙ্গে নিয়ে আরও এক বার তাঁরা গেলেন বাড়ির লোকজনের কাছে। সঙ্গী হল আনন্দবাজারও।

বড়সড় দোতলা বাড়ি। নীচে পারিবারিক রেশন দোকান। সেখানে বসে ছিলেন ভগ্নিপতি দিলীপ। লোকজন দেখে তড়িঘড়ি চলে এলেন। এলেন পরিবারের ছোট মেয়ে শম্পা সাধুখাঁও। তাঁরাই দোতলায় ডাকতে গেলেন মাকে। অশীতিপর বরুণা সাধুখাঁ কোনও মতে এসে বসলেন। থানার অফিসার প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনি চান না আপনার ছেলে নিজের বাড়িতে থাকুক?’’ বৃদ্ধা মাথা নিচু করে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তার পর বললেন, ‘‘আমি কী বলব? আমি নিজেই খুব অসুস্থ। নিজের দায়িত্বটুকুই নিতে পারি না।’’ হঠাৎ পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন শম্পা। বললেন, ‘‘বাড়িতে ওকে থাকতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’’ কেন? সুপ্রিয়বাবুর কি নিজের বাড়িতে কোনও অধিকার নেই? শম্পার জবাব, ‘‘না, নেই। আমরা কোনও অধিকার দেব না।’’

অদূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন দিলীপ। তাঁর স্ত্রী সুমিতা তখন বাড়িতে ছিলেন না। নিজে কোনও কথা না বললেও মাঝেমধ্যেই শ্যালিকাকে খুব নিচু স্বরে কিছু বলছিলেন। ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন শম্পা। পুলিশ আইনি পথে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলে হুমকির সুরে শম্পা বললেন, ‘‘আপনারা কারও ভাল করতে পারেন না। খারাপ করে বেড়ান। দেখি, কী করে আমাদের এত বড় খারাপটা করেন।’’ নিজের দাদাকে বাড়ি ফেরানোটাকে ‘খারাপ’ মনে করছেন কেন? শম্পার জবাব, ‘‘ও একটা হিংস্র পাগল। পাগল কখনও ভাল হয় না। আমরা পাগলের কোনও সংস্রবে থাকব না। ব্যস্।’’

‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ মনে পড়ে? বছরের পর বছর জড়ভরত হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকা আনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু ভালবাসার ছোঁয়ায় সারিয়ে তুলেছিলেন ‘মুন্নাভাই’ সঞ্জয় দত্ত। ছবির শেষে দেখা যায়, বাড়ি ফেরার আগে অ্যালবাম দেখিয়ে ছোটদের মুন্নাভাইয়ের গল্প শোনাচ্ছেন সেই আনন্দ। সুপ্রিয়বাবু তা-ও এলাকায় ফিরেছেন। পাড়ার লোকের চাপে এখন মাঝেমধ্যে তাঁকে খাবারও পাঠাচ্ছেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু মানসিক হাসপাতালগুলোয় এখনও এমন অনেকের খোঁজ মেলে, যাঁদের পরিবারের দেখাই নেই বহু বছর।

চিকিৎসকদের আক্ষেপ, অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন না যে, মনোরোগী কখনও সুস্থ হতে পারেন! আর তাই সমাজে-সম্পত্তিতে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এত কঠিন হয়ে পড়ে। মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায়ের মতে, ‘‘এমন মানুষদের সঙ্গে পরিবার অধিকাংশ সময়েই খুব খারাপ ব্যবহার করে। সেই কারণেই বিকল্প পরিবারের ভূমিকাটা ক্রমশ জরুরি হয়ে পড়ছে।’’

সুপ্রিয়বাবুর ‘বিকল্প’ পরিবারের সদস্যরা অবশ্য এত তত্ত্বকথা বোঝেন না। কৃশানু মৈত্র, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, দুলাল সিংহ, গোপাল হালদারদের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘একটা মানুষ এ ভাবে নিজের অধিকার হারাবে। আর আমরা যদি চুপচাপ বসে থাকি, তা হলে কি আর নিজেদের মানুষ বলে দাবি করতে পারব? শুধু সুপ্রিয়কে ওর নিজের বাড়িতে ঢোকানো নয়, ওর রোজগারের ব্যবস্থাও করতে হবে। ফেরাতে হবে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস। এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।’’

সেই কাজে তাঁরা যে ইতিমধ্যেই কিছুটা সফল, বোঝা গেল সুপ্রিয়বাবুর কথায়। জানান, এত মানুষের সহানুভূতি পেয়ে ভাল লাগছে। কিন্তু বাকি জীবনটা অন্যের দয়ায় বাঁচতে চান না। তাঁর কথায়, ‘‘আগে রেডিও সারাতাম। সেই সব যন্ত্রপাতি বাড়ির লোকেরা ফেলে দিয়েছে। আবার সেগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমি ঘুরে দাঁড়াবই।’’

মুখে তখন প্রত্যয়ের স্মিত হাসি।

Patient mental hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy