কী সেই বক্তব্য? নেতাজি ভবনে দাঁড়িয়ে অন্তত নেতাজির জন্মবার্ষিকীকে কোনও ভাবেই দলীয় শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীকে যদি তাঁর দলীয় নেতৃবর্গ অভ্যর্থনা জানাতে চান, তা করতে হবে নেতাজি ভবনের বাইরে। নেতাজি ভবনে প্রধানমন্ত্রীকে ‘রিসিভ’ করবেন শুধুমাত্র সুগত ও সুমন্ত্র। এবং প্রধানমন্ত্রীর আগমন হেতু দীর্ঘক্ষণ ভবনের দরজা বন্ধ রেখে সাধারণ মানুষকে তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণে বাধা দেওয়া যাবে না।
সুগত এও মনে করিয়ে দেন, সকালের অনুষ্ঠানে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই উপস্থিত হয়েছিলেম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনিও এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়েই, অনুষ্ঠানে উপবিষ্ট হয়েছিলেন একা। তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনও কনভয় আসেনি।
নেতাজি ভবনের এই সব ক’টি শর্তই মেনে নেয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর (পিএমও)। তার আগেই অবশ্য দুপুর থেকে ভবনের সামনের রাস্তায় বিজেপি কর্মীদের বিক্ষিপ্ত আনাগোনা চোখে পড়ছিল। নেতাজি ভবনে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে কোন কোন নেতা-নেত্রী আসতে চ
লেছেন, ঘুরছিল সেই সব নামও। তিনটের পরই ভবনের সামনে উপস্থিত হয়ে যান কৈলাস বিজয়বর্গীয়, চন্দ্র বসু, স্বপন দাশগুপ্ত প্রমুখ। তিনটে পঁচিশ নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর কনভয় এসে পৌঁছয়। সেখানে মোদীর সঙ্গী রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। মোদী গাড়ি থেকে নামতেই ‘মোদী মোদী’, ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বনিতে মুখর হয় লাজপত রায় সরণি। নেতাজি ভবনে মহানিষ্ক্রমণের সেই গাড়ি, সুভাষচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের ঘর, সংগ্রহশালা ঘুরে দেখে মিনিট পনেরো পরে বেরিয়ে হাত নাড়ার সময় তাতে যোগ হল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানও। নেতাজি নন, মোদীর পরাক্রমই তখন প্রকট!
সুগত পরে বলছিলেন, ‘‘এই দিনটা অন্তত ‘নেতাজি জিন্দাবাদ’ বা ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনিই প্রত্যাশিত ছিল!’’ তবে, ইদানীং সুভাষচন্দ্রকে নানা উপায়ে ‘আত্মসাৎ করার যে নির্লজ্জ প্রবণতা’ দেখা যাচ্ছে, সে কথা সকালের বক্তৃতাতেই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানের শেষে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘সুভাষচন্দ্রের ‘পরাক্রম’কে সবচেয়ে বেশি করে তুলে ধরা মানে তাঁকে শুধু যোদ্ধায় পরিণত করা। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সুভাষকে ‘দেশনায়ক’-এর শিরোপা দিয়েছিলেন।’’ রাজ্য সরকার যে সেই কারণেই দিনটিকে দেশনায়ক দিবস হিসেবে পালন করছে, সে কথা উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রীও। কেন্দ্রীয় সরকার মুখে সুভাষের কথা বললেও তাঁর আদর্শকে সম্মান করে না বলে অভিযোগ করে মমতা বলেন, নইলে যোজনা কমিশন তুলে দিত না কেন্দ্র! কলকাতা বন্দরের নামও বদলাত না!
ভোটের তাস বনাম আদর্শের আবাহন! বিভাজন-বিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িকতায় কলুষিত এই আবহে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সুভাষের আপসহীন অবস্থানের কথাই তো এ দিন বারবার তুলে ধরতে চেয়েছে নেতাজি ভবনও। নেতাজির অতি ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা আবিদ হাসানকে মরণোত্তর নেতাজি সম্মানে ভূষিত করে, লেখায়-কথায় আবিদকে স্মরণ করে, আবিদের সূত্রে নেতাজির স্মৃতিতে অবগাহন করে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে, সুভাষচন্দ্রের কাছে দেশপ্রেমই ছিল ঐক্যবন্ধন। ধর্ম আর জাতীয়তাবাদকে মিশিয়ে দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুরে চেট্টিয়ার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে যেতে না পারলে যাবই না!’’
সুগত গেয়ে শোনালেন, ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত’-র সেই স্তবক আর আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গীতে তার অনুবাদ। বললেন, প্রেমহারেই দেশকে গাঁথতে চেয়েছিলেন সুভাষ, বিভাজনের মন্ত্রে নয়! মঞ্চে তখন গানের সঙ্গে তালি দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী! দেশনায়কের পরাক্রম থাকতেই পারে, কিন্তু পরাক্রম থাকলেই দেশনায়ক হওয়া যায় কি— দিনভর যেন এই প্রশ্নই নীরবে বাঙ্ময় রইল নেতাজি ভবনে।