Advertisement
২১ মে ২০২৪

বান্টি-খুনের দু’বছর পরে রাজার বিরুদ্ধে এফআইআর

বছর পঁচিশের পায়েল যেন উদয়ন পণ্ডিত! হীরক রাজ্যে রাজ-বিদ্রোহের জন্য হিরের খনিতে ঘাপটি মেরে ছিলেন উদয়ন। হালিশহরেও রাজ-বিদ্রোহের জন্য এত দিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন পায়েল ঘোষ। নিহত রাজ-অনুচর বান্টির স্ত্রী। মুখ খুলেছেন তিনি আগেই।

বিতান ভট্টাচার্য ও সুপ্রকাশ মণ্ডল
হালিশহর শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৬ ০৩:৩১
Share: Save:

বছর পঁচিশের পায়েল যেন উদয়ন পণ্ডিত!

হীরক রাজ্যে রাজ-বিদ্রোহের জন্য হিরের খনিতে ঘাপটি মেরে ছিলেন উদয়ন।

হালিশহরেও রাজ-বিদ্রোহের জন্য এত দিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন পায়েল ঘোষ। নিহত রাজ-অনুচর বান্টির স্ত্রী। মুখ খুলেছেন তিনি আগেই। এ বার রাজার বিরুদ্ধে যখন ধীরে ধীরে জনমত তৈরি হচ্ছে, তখন সরাসরি ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনারের কাছে গিয়ে রাজার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলেন তিনি। রবিবার করা ওই অভিযোগে পায়েল জানিয়েছেন, দু’বছর আগে তাঁর স্বামীকে খুনের মূল চক্রী হালিশহরের বর্তমান উপ-পুরপ্রধান রাজা দত্তই।

রাজার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হওয়া যে বড় ঘটনা, এ দিন তা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন শহরবাসী। কেননা, এত দিন সেই সাহস কেউ করেননি। ‘রায়বাড়ি’ পাশে থাকার জন্যই রাজা বহু ‘অপকর্ম’ করেও পার পেয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলছিলেন বিরোধীরা। এলাকার বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়ের সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠতার কথাও কারও অজানা নয়। এত দিন ‘রাজ-কাহিনি’ নিয়ে মুখও খোলেননি শুভ্রাংশু। ভোটের আগের দিন বারেন্দ্র গলিতে সমাজপতি পরিবারের উপরে হামলার পরেই রাজার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন ওই বাড়ির মেয়ে দেবশ্রী ঘোষ। তার পরে একে একে আরও কয়েক জন। তখনও চুপ থেকেছে ‘রায়বাড়ি’।

তবে, শনিবার ওই বাড়িতে গিয়ে শুভ্রাংশুর বাবা, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়ে আসেন। যা শুনে বিরোধীরা মনে করছেন, এলাকায় ভাবমূর্তি ধরে রাখতেই রাজার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছে ‘রায়বাড়ি’। তাঁদের সেই ধারণা আরও প্রবল হয়েছে রবিবার শুভ্রাংশুর মন্তব্যেও। বাবা মুকুল রায়ের সুরেই সমাজপতি-বাড়িতে হামলার ঘটনায় শুভ্রাংশু বলেছেন, ‘‘দোষীর শাস্তি হবে।’’

অথচ, এ যাবৎ শহরে রাজা দত্তের বিরুদ্ধে নানা বেআইনি কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলেও পুলিশকে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাতেও ‘রায়বাড়ি’র অঙ্গুলি-হেলনই দেখেছে বিরোধীরা। পুলিশ বারবারই দাবি করেছে, রাজার বিরুদ্ধে থানায় কোনও লিখিত অভিযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে কী ভাবে পদক্ষেপ করা হবে? এত দিন বাদে রাজার বিরুদ্ধে এফআইআর হওয়ার পরে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ অবশ্য বলেছেন, ‘‘রাজার বিরুদ্ধে এই অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। তদন্ত শুরু হয়েছে। আইন অনুযায়ী যা পদক্ষেপ দরকার, সবই করা হবে।’’

২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি বকুলতলায় খুন হয় সৈকত ঘোষ ওরফে বান্টি। নিজে জমির ব্যবসা শুরু করাতেই সে রাজার কোপে পড়ে বলে অভিযোগ। সেই ঘটনায় পুলিশ এবং সিআইডি রাজার দলেরই সাত জনকে গ্রেফতার করেছিল। ধৃতেরা এখন জামিনে রয়েছে। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি সেই সময়। এত দিন বাদে কেন পায়েল এফআইআর করলেন?

পায়েলের দাবি, ‘‘সেই সময় রাজার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গেলেও পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। তখন রাজার দাপট এতটাই বেশি ছিল যে, আমরাও সাহস পাইনি। এখন অনেকে মুখ খোলায় সাহস পাচ্ছি। রাজাই স্বামীকে খুনের আসল মাথা। স্বামীকে না সরালে জমি-ব্যবসায় রাজার আধিপত্য থাকত না।’’

সে দিনের স্মৃতি এখনও টাটকা পায়েলের। তিনি জানান, ফোন করে আলোচনার জন্য রাজার অনুচররা স্বামীকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল বকুলতলায়। মনে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বান্টিকে গুলি করা হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় এলাকার লোকজন তাকে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ সেখানেই সে মারা যায়। এত কিছু ঘটে গেলেও তাঁদের একবারের জন্যও খবর দেওয়া হয়নি। পরদিন ভোরবেলা তাঁদের জানানো হয়, বান্টি হাসপাতালের আইসিইউ-তে রয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে তাঁরা পুরো ঘটনা জানতে পারেন।

শহরের বহু বাসিন্দাই জানিয়েছেন, পুকুর-ভরাট থেকে বালি-খাদান, তোলাবাজি-সহ নানা ‘অপকর্ম’ করেও রাজা এতদিন বুক বাজিয়ে বলে বেড়াত, তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনও অভিযোগ নেই। এ বার কী বলবে রাজা? তার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। এ দিন শহরে একটি রবীন্দ্র-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে রাজা গিয়েছিল। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ ছিল। তবে, তার চ্যালারা শনিবারই জানিয়েছিল, ‘দাদা’ মুষড়ে পড়েছে। কেননা, নানা ভাবে মুকুলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ‘দাদা’ সফল হয়নি।

শুভ্রাংশু এ দিন দাবি করেছেন, আগে পাশে থাকার কথা বললেও স্ত্রী অসুস্থ থাকার জন্য তিনি সমাজপতি বাড়িতে যাওয়ার সময় পাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি অবশ্যই ওই বাড়িতে যাব। বাচ্চাদের আমি খুব ভালবাসি। ওই বাচ্চাটির (সায়ন্তিকা) সঙ্গে আমি অনেকটা সময় কাটাব। ওঁরা যে রাজনৈতিক দলেরই সমর্থক হোন, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই।’’ যদিও রাজাকে নিয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি। মুকুল রায়ের পরে শুভ্রাংশুও তার সমর্থনে কিছু না বলায় রাজার ‘বর্ম’ ভাঙছে বলেই মনে করছেন বিরোধীরা। পায়েল রাজার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করায় খুশি সমাজপতি-বাড়ির মেয়ে দেবশ্রীও।

দড়ি ধরে টান আগেই পড়েছিল। এ বার সেই টানে জোর বাড়ল। রাজার খান খান হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা— বলছে হালিশহর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bunty Murder Case Raja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE