কয়েক দিনের টানা বর্ষণে জলমগ্ন দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা। ইতিমধ্যে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা এবং ঘাটালে। হাওড়ার কিছু অংশেও দুর্দশার ছবি। তবে বাঁকুড়ার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে বানের জলে ভেসে গিয়েছেন রাজ্যের এক বাসিন্দা। পশ্চিম মেদিনীপুরে তৈরি হয়েছে ত্রাণশিবির। জলমগ্ন এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে কোথাও স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়লেন প্রশাসনের লোকজন।
পশ্চিম মেদিনীপুর
১৯৭৮ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতায় বন্যা হয়েছিল। তার পর এ বার টানা বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ওই এলাকায়। গড়বেতা-১ ও ২ ব্লকের ২১টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে সেখানে আশ্রয় দিয়েছে প্রশাসন। বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৬৬.৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শিলাবতী নদী। তার ফলে গড়বেতা-১ ব্লকের ১০টি এবং গড়বেতা-২ ব্লকে চারটি অঞ্চল প্লাবিত। আগড়া, ধাদিকা, খরকুশমা, বড়মুড়া, সন্ধিপুর, গরঙ্গা, পিয়াশালা, জোগাড়ডাঙা, সারবত, আমলাশুলি এলাকায় শুক্রবার থেকে কিছুটা নামতে শুরু করলেও এখনও জলমগ্ন ওই সমস্ত এলাকা। ব্রাহ্মণ গ্রাম এলাকায় মেদিনীপুর থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তা ধসে গিয়েছে। শুক্রবার রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের সচিবদের নিয়ে প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনে যান মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদরি, পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার এবং বিধায়ক উত্তরা সিংহ হাজরা ছিলেন মানসের সঙ্গে। ত্রাণ শিবিরে নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করেন মন্ত্রী। প্লাবিত এলাকার বাসিন্দাদের খাবার পরিবেশন করেছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। শুধু গড়বেতাই নয়, ঘাটালের চন্দ্রকোনার পরিস্থিতিও খারাপ।
শুক্রবার নতুন করে প্লাবিত হতে শুরু করেছে ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন এলাকা। ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কাজ শুরু হলেও বন্যার কারণে বেশ কিছু জায়গায় কাজ থমকে গিয়েছে। ‘ড্রোন ভিউ’-তে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন প্রশাসনের কর্তারা। দেখা যায়, বেশ কিছু বাঁশের সাঁকো জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন অনেক বাসিন্দা। তাঁদের উদ্ধার করতে নেমেছে এনডিআরএফ। অসুস্থদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার উপর জল উঠে আসায় আটকে পড়ে বেশ কিছু গাড়ি। সম্ভাব্য বিপদ থেকে ওই যাত্রীদের উদ্ধার করছে প্রশাসন। জেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনের পরে মন্ত্রী মানস বলেন, ‘‘গড়বেতায় ’৭৮ সালের পর এত বড় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওই সমস্ত এলাকার বাসিন্দাদের উদ্ধার করে ত্রাণশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী পরিস্থিতির কথা জানতে পেরে বিভিন্ন দফতরের সচিবদের এলাকা পরিদর্শনে পাঠিয়েছেন।’’ চিকিৎসক-মন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘প্রসূতি মায়েদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে। তা ছাড়া এই সময়ে সাপের কামড় থেকে রক্ষার জন্য সতর্কতা নিতে হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সকলের পাশে রয়েছেন। চিন্তার কিছু নেই। পুলিশ-প্রশাসনের তরফে ড্রোন উড়িয়ে নজরদারি চালানো হচ্ছে। কোথাও কেউ আটকে রয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে তারা। জলের তোড়ে ভেসে গেলেও তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন। ঘাটাল মহকুমা শাসক সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘‘চন্দ্রকোনা-১ ও ২ ব্লক এবং ঘাটালে ৩৩টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। পরিস্থিতির দিকে আমরা নজর রাখছি। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন:
জলের তোড়ে ভেসে গেলেন এক ব্যক্তি!
আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে তলিয়ে গেলেন এক ব্যক্তি। নাম তুলসী রুইদাস। ৪২ বছরের তুলসীর বাড়ি চন্দ্রকোনার ছত্রগঞ্জে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চন্দ্রকোনার পলাশচাপড়ি এলাকায় রাজ্য সড়ক পারাপার করতে গিয়ে জলের স্রোতে তলিয়ে যান তিনি। তুলসীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-ও ভেসে যাচ্ছিলেন। স্থানীয়েরা তাঁকে উদ্ধার করতে পারলেও ভেসে যান তুলসী। এখনও তাঁর দেহ উদ্ধার হয়নি। প্রশাসনের কাছে পরিবারের আবেদন, তুলসীকে খুঁজে বার করা হোক।
হাওড়া
বৃষ্টি এবং ডিভিসি-র ছাড়া জলে আবার ভয়াবহ পরিস্থিতি হাওড়ার আমতায়। শুক্রবার জলের তোড়ে সেখানকার দুটি বাঁশের সাঁকো ভেসে গিয়েছে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন আমতা-২ ব্লকের ভাটোরা দীপাঞ্চল। গত কয়েক দিনে ডিভিসি থেকে দফায় দফায় জল ছাড়ার ফলে মুণ্ডেশ্বরী নদীর জলস্তর বেড়েছে। তার পর দফায় দফায় বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে ওঠে নদী। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জলের ধাক্কায় আমতার গায়েনপাড়া এবং কুলিয়ায় দুটি বাঁশের সাঁকো ভেসে যায়। যদিও হুগলির সঙ্গে সংযোগকারী জাঙ্গিপাড়ায় বাঁশের সেতুটি এখনও কোনও রকমে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। তবে যে কোনও মুহূর্তে সেটিও ভেসে যেতে পারে। চরম দুর্ভোগে ভাটোরা দীপাঞ্চলের কয়েক হাজার বাসিন্দা। নদী পেরোতে না পেরে আটকে পড়েছেন তাঁরা। সে জন্য প্রশাসন ফেরি পরিষেবা চালু করেছে। এখন নৌকা এবং ছোট ছোট ভুটভুটিতে যাত্রীদের পারাপার করা হচ্ছে। স্থানীয় বিধায়ক সুকান্ত পাল বলেন, ‘‘বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে। গোটা পরিস্থিতির উপর নজর আছে। যাত্রীদের যাতে অসুবিধা না-হয় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’
হুগলি
রাস্তায় বৃষ্টির জল উঠেছে। বিপদের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছেন মানুষজন। হুগলির আরামবাগ-বদনগঞ্জ, গড়বেতা রাস্তার উপর গোঘাটের সাতবেড়িয়া দিয়ে বন্যার জলের স্রোত বইছে। কামারপুকুর ও জয়রামবাটির মধ্যবর্তী হলদি পোলের উপর দিয়ে জল বইছে। বাঁকুড়ার দিক থেকে প্রবাহিত বন্যার জল দু’টি রাস্তার উপর দিয়েই বয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে সবজিখেত জলের তলায়। মাথায় হাত কৃষকদের। টানা বৃষ্টির জেরে পশ্চিমের জল গড়িয়ে আসার কারণে এই পরিস্থিতি। আরও বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
আরামবাগের প্রাক্-বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য এবং নদীবাঁধগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে আরামবাগে যান রাজ্য সরকারের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব মণীশ জৈন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হুগলির জেলাশাসক মুক্তা আর্য, হুগলি জেলা পরিষদের সভাধিপতি রঞ্জন ধাড়া, আরামবাগের মহকুমাশাসক রবিকুমার, সাংসদ মিতালি বাগেরা। খানাকুলের বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত মাড়োখানা এলাকার নদীবাঁধগুলি পরিদর্শন করেন তাঁরা। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ,তাঁদের দাবিদাওয়া, অসুবিধার কথা শুনতে চায়নি প্রতিনিধি দল। ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয়েরা। উল্লেখ্য, আরামবাগ মহকুমার উপর দিয়ে প্রবাহিত দামোদর ও দামোদরের শাখানদী মুণ্ডেশ্বরী দিয়ে ডিভিসির জল প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য দিকে, বাঁকুড়ার দিক থেকে দ্বারকেশ্বর নদে ক্রমশই জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কিত এলাকার মানুষজন।
বাঁকুড়া
শুক্রবার নতুন করে বৃষ্টি হয়নি। তাই সামগ্রিক ভাবে বাঁকুড়া জেলায় বন্যা পতিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। শিলাবতী ও দামোদরের জল নামায় জলমুক্ত হয়েছে একাধিক সড়ক এবং সেতু। তবে গন্ধেশ্বরী ও দারকেশ্বরের জলস্তরে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন স্থানীয়েরা। শুক্রবার বাঁকুড়া সদর ও বিষ্ণুপুর মহকুমা এলাকায় রাজ্য সরকারের দু’টি পৃথক আধিকারিক দল বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে।
মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার টানা বৃষ্টি হয়েছে বাঁকুড়ায়। এখন অবশ্য দামোদরের জলস্তর নেমে যাওয়ায় জলমুক্ত হয়েছে কোতুলপুর থেকে জয়রামবাটি যাওয়ার রাজ্য সড়ক। তবে এখনও জলের তলায় গন্ধেশ্বরী নদীর মানকানালি সেতু ও দ্বারকেশ্বরের উপর ভাদুল এবং মীনাপুর সেতু। ওই তিনটি সেতু দিয়ে শুক্রবারও পারাপার বন্ধ ছিল। জয়পণ্ডা নদীর জলের স্তর কিছুটা নামলেও তালড্যাংরা ব্লকের জলমগ্ন পাঁচমুড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাড়িতে ফিরতে পারেননি ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেওয়া দুর্গতেরা। গ্রামগুলি জলমুক্ত হলেও কাঁচাবাড়ি ধসে বিপত্তির আশঙ্কায় এলাকার পাঁচটি ত্রাণশিবিরে বাসিন্দাদের উঠে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। জানা গিয়েছে, জেলার ২২ টি ব্লকের মধ্যে ১০টি ব্লকের মোট ৩৫০টি গ্রাম কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা জুড়ে ৫০০ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছে প্রায় দেড়শো বাড়ি। শুক্রবার অস্থায়ী রাস্তা এবং বিড়াই নদীর জলে প্লাবিত সুভাষপল্লি এলাকার সেতু পরিদর্শন করেন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতরের সচিব স্মারকি মহাপাত্র।