E-Paper

বাদাবনে বাঘের বাড়বৃদ্ধিতে কি ‘দেশান্তরী’-ভিড়

সংখ্যাটা নির্দিষ্ট নয়, তবে হালফিলের ব্যাঘ্র শুমারিতে সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এই নতুন অতিথিদের ‘অবদান’কে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখতে চাইছেন তাঁরা।

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ০৮:৫১
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

অনুপ্রবেশের আবহে কিছু অনাহূত আগমনকে অবশ্য সাদর আমন্ত্রণই জানাচ্ছেন বন্যপ্রেমীরা! নদী-নালা কিংবা সমুদ্র মোহনার অজস্র খাঁড়ির অস্পষ্ট সীমান্ত উজিয়ে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে বাঘের আনাগোনা স্বস্তিই জুগিয়েছে এ দেশের বন মন্ত্রককে। সুন্দরবনের জল-জঙ্গলে এই ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ তাই স্বাগত জানাচ্ছেন দেশের তামাম বাঘ বিশেষজ্ঞরা।

সংখ্যাটা নির্দিষ্ট নয়, তবে হালফিলের ব্যাঘ্র শুমারিতে সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এই নতুন অতিথিদের ‘অবদান’কে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখতে চাইছেন তাঁরা। বাঘ সংরক্ষণে দেশের সর্বোচ্চ সংস্থা ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজ়ারভেশন অথরিটি’ (এনটিসিএ) ‘দক্ষিণ রায়’-এর সংখ্যা বৃদ্ধিতে এই কারণটিকেও অন্যতম বলে সিলমোহর দিয়েছে। সংস্থার সদস্য সচিব তথা এডিজি গোবিন্দ সাগর ভরদ্বাজ বলছেন, ‘‘বন্যপ্রাণ তো সীমান্ত মেনে চলাচল করে না, ফলে ও-দেশের সুন্দরবনের বাঘ এ-দেশের বাদাবনে বসত করতেই পারে।’’ দেশের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবও প্রায় একই সুরে বলেন, ‘‘বাঘ তার আদর্শ বসতের খোঁজে সীমান্ত উজিয়ে চলাচল করে। আমাদের দেশের বাঘও কখনও ভুটানে চলে যায়, হাতিরা হামেশাই পাড়ি দেয় নেপালে।’’ রাজ্যের বন দফতররের এক শীর্ষ কর্তা এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে না দিলেও এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য অবশ্য দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘‘পরিসংখ্যান অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে ঠিকই তবে তার কারণ নিয়ে এখনই কোনও নির্দিষ্ট মতামত দেওয়া সম্ভব নয়।’’

গত তিন দশকের নিয়ম মেনে, প্রতি সাড়ে তিন বছর অন্তর দেশ জুড়ে বাঘ শুমারির পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করছে, বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধির হার ঊর্দ্ধমুখী। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকাও তার ব্যতিক্রম নয়। গত শুমারির তুলনায় এ বারও বিস্তীর্ণ বাদাবনে অন্তত ২০ থেকে ২১টি বাঘ বেড়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। পাগমার্ক বা পায়ের ছাপ নয়, বাঘ গণনার সাম্প্রতিক উপায় হল— লুকনো ক্যামেরা (ট্র্যাপ ক্যামেরা) এবং সাইটিং বা সরাসরি বাঘ দেখার পর তার গায়ের রং, লেজের গড়ন, মুখের আনুমানিক আকার-আয়তন, গায়ের কালো-হলুদ ডোরা বিশ্লেষণ করা। সেই নিরিখেই ২০২১ সালের গণনায় বাঘের সংখ্যা ছিল ৯৯ থেকে ১০১টি। এখন তা ১২০ থেকে ১২১।

বার্ধক্যের ত্বকে ছড়িয়ে থাকা অজস্র বলিরেখার মতো নদী-নালা-খাঁড়ি আর শ’দেড়েক দ্বীপ, ১৬৯৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই হল সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের সাবেক ঠিকানা। মোহনার বুকে নিত্য জেগে ওঠে দ্বীপ কখনও বা বছর ঘোরার আগেই ফের সে তলিয়ে যায় সমুদ্রের অতলে। এই হিসেবহীন দ্বীপ-রাজ্যে মানুষের বসত সাকুল্যে ৫৪টিতে। বাকিটা বাঘ ও বন্যপ্রাণের অবাধ সাম্রাজ্য। ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোল ঘেঁষেই কাঁটাতারহীন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে সুন্দরবনের সিংহভাগ অংশ বাংলাদেশে হলেও সে দেশে বাঘের সংখ্যা বা বনাঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বাঘের দেশান্তরী হওয়ার কারণ লুকিয়ে রয়েছে এখানেই, মনে করেন ম্যানগ্রোভ বিশেষজ্ঞ হরিশ বাদানি। উষ্ণায়ন সম্পর্কিত আমেরিকান গবেষক হরিশ বলেন, ‘‘বিশ্ব উষ্ণায়নের থাবার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে ব্রাজ়িলের আমাজন। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের বাদাবন (ম্যানগ্রোভ)। এর মধ্যে বাংলাদেশের সুন্দরবনই সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে প্রতি বছর জলস্তর বাড়ছে প্রায় ৬.৬ মিলিমিটার হারে। তুলনায় ভারতের সুন্দরবনে সেই জলস্তর বৃদ্ধির হার কিঞ্চিৎ কম।’’ তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে, জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যেতে বসা বাদাবন জুড়ে ক্রমশ বাড়ছে নোনা জলের পরিমাণ। জঙ্গলের গভীরে থাকা মিষ্টি জলের পুকুরগুলিও হারিয়ে যাওয়ার মুখে। নিজের বসতে জলসঙ্কটের পাশাপাশি টান পড়েছে তার হাঁড়িতেও। কারণ, বাঘের খাদ্য তালিকায় থাকা হরিণ, বন শুয়োর, ভোঁদর, বাঁদরের সংখ্যাও একই কারণে নিম্নমুখী। এই জোড়া অশনি সঙ্কেতে বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের বাঘ নদী-নালার সীমানা ভেঙে পাড়ি দিচ্ছে এ দেশের জঙ্গলে। দেশের বাঘ বিশেষজ্ঞ সমীর সাংখালা ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘এক দিকে খাবারে টান, নোনা জলে ভেসে যাচ্ছে আবাস, অন্য দিকে মাটিতে নুনের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে আসছে বাংলাদেশের সুন্দরবনের বনাঞ্চলও। ফলে বাঘের নিজস্ব এলাকার পরিধি বা ‘টেরিটোরি’ ছোট হয়ে আসায় প্রায়শই সংঘাত বাধছে। পরাজিত বাঘ নয়া বসতের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে এ দেশের বাদাবনে।’’ বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুন্ডু মনে করেন ‘দেশান্তরী’ বাঘের ‘অনুপ্রবেশের’ এই সহজ পথটি উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট রেঞ্জের কাছে রায়মঙ্গল নদী বরাবর বিছিয়ে রয়েছে। দু’দেশের মাঝে নদীর সীমানাটুকু সাঁতরে নয়া বসতের খোঁজ করছে ও-পারের বাঘ। তবে, বাঘের দেশান্তরী হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের মুখ্য বনপাল আমীর হোসেন চৌধুরী। তিনি জানান, সুন্দরবনের সিংহভাগই রয়েছে বাংলাদেশে। তাঁর দাবি, সেখানে বাঘের বাসস্থান বা খাদ্য সঙ্কটের কোনও প্রশ্নও নেই। বাঘের দেশান্তরী হওয়ার সম্ভাবনাও মানতে নারাজ তিনি। চাপানউতোরের মাঝে প্রশ্নটা তবু থেকেই যাচ্ছে— অনুপ্রবেশের অভিঘাতেই কি সুন্দরবনে ব্যাঘ্রকুলের বাড়বৃদ্ধি!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sundarbans Tiger

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy