Advertisement
E-Paper

পাঁচ সঙ্কটে ভুগছে পশ্চিমবঙ্গ! ১৮ মিনিট তৃণমূলকে তোপ, ৮ মিনিট সিঁদুর অভিযান, ভোটের ভেরী বাজিয়েই দিলেন মোদী

আলিপুরদুয়ারে বৃহস্পতিবার মোট ৩২ মিনিট ভাষণ দিয়েছেন মোদী। তার মধ্যে ১৮ মিনিট ব্যয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং শাসক তৃণমূলকে আক্রমণ করতে। ৮ মিনিট সময় নিয়েছেন ‘অপারেশন’ সিঁদুর’ প্রসঙ্গে।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ১৭:১২
From Alipurduar rally Modi blows the electoral bugle for Bengal Polls pending in 2026, Attacks TMC with steep jibes

বৃহস্পতিবার আলিপুরদুয়ারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: সংগৃহীত।

পোশাকি নাম ছিল ‘পরিবর্তন সঙ্কল্প সভা’। ‘অপারেশন সিঁদুরে’র কথা উঠলেও আসলে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ডাক দেওয়াই যে সভার মূল উদ্দেশ্য, তা কর্মসূচির নাম প্রকাশ্যে আসতেই স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কোন প্রসঙ্গ কতটা জুড়ে থাকবে, তা রাজ্য বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছেও স্পষ্ট ছিল না। ফলে শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদারের সংক্ষিপ্ত ভাষণে ‘সিঁদুর’ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পেল। কিন্তু তার পরে সভার মেজাজ বদলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং।

আলিপুরদুয়ারে বৃহস্পতিবার মোট ৩২ মিনিট ভাষণ দিয়েছেন মোদী। তার মধ্যে ১৮ মিনিট ব্যয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং শাসক তৃণমূলকে আক্রমণ করতে। ৮ মিনিট সময় নিয়েছেন ‘অপারেশন’ সিঁদুর’ প্রসঙ্গে। তাঁর ভাষণের বাকি ৬ মিনিট বরাদ্দ থেকেছে সম্ভাষণ-সহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে বার বার ‘নির্মম সরকার’ বলে আক্রমণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যা থেকে স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গে এখন তাঁর নজর পরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে। বস্তুত, ভাষণের শেষে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কর্মীদের কার্যত ভোটের ময়দানে নেমে পড়ার পরামর্শই দিয়ে গিয়েছেন মোদী। বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রের উপরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কর্মীদের আমি কোমর বেঁধে প্রস্তুত হতে বলছি।’’

বৃহস্পতিবার সকালে খারাপ আবহাওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টার বাগডোগরা থেকে সিকিমের উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। বাগডোগরা থেকেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে সিকিমের কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। তার পরে আলিপুরদুয়ারে রওনা হয়ে হন। নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দুয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী পৌঁছে গিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে। ফলে তাঁর দুই কর্মসূচিই নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগে শুরু হয়। প্রথমে প্রশাসনিক মঞ্চ থেকে আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জেলার জন্য পাইপলাইনে রান্নার গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন মোদী। তার পরে পৌঁছোন ‘পরিবর্তন সঙ্কল্প সভা’র মঞ্চে। রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু এবং রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত ভাষণ দেন মোদীর আগে। দু’জনেই সর্বাগ্রে ‘অপারেশন সিঁদুরে’র সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি দেন। তার পরে দু’জনেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোষণ তথা সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে সরব হন। কিন্তু স্থানীয় নেতাদের ছাপিয়ে যান মোদী।

প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ এই মহূর্তে নানা সঙ্কটের ঘেরাটোপে।’’ এমন পাঁচটি ‘সঙ্কটের’ কথা উল্লেখ করেন তিনি। মোদীর কথায়, ‘‘প্রথম সঙ্কট, সমাজে ছড়িয়ে পড়া হিংসা এবং অরাজকতা। দ্বিতীয় সঙ্কট, মা-বোনেদের নিরাপত্তার অভাব, তাঁদের উপরে অত্যাচার। তৃতীয় সঙ্কট, যুবকদের মধ্যে ঘোর নিরাশা, বেকারত্বের যন্ত্রণা। চতুর্থ সঙ্কট, ঘনঘোর দুর্নীতি এবং তার ফলে এখানকার প্রশাসনের উপরে জনতার বিশ্বাস একনাগাড়ে কমতে থাকা। পঞ্চম সঙ্কট, গরিবের অধিকার ছিনিয়ে নিতে থাকা ক্ষমতাসীন স্বার্থপর রাজনৈতিক দল।’’

মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের অশান্তির প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগ তোলেন মোদী। তৃণমূলের বিধায়ক, কাউন্সিলর, স্থানীয় নেতারা ওই অশান্তিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে তোপ দাগেন। মোদীর কথায়, ‘‘মালদহ, মুর্শিদাবাদে যা হয়েছে, তা এখানকার শাসকদলের নির্মমতার দৃষ্টান্ত! আমি বাংলার জনতাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, এই ভাবে সরকার চলে? এই ভাবে সরকার চলবে?’’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলার মানুষের একমাত্র আশ্রয় এখন আদালত। সব বিষয়ে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।’’ এর পরেই মোদী স্লোগান বেঁধে দেন— ‘বাংলার চিৎকার, লাগবে না নির্মম সরকার’।

চাকরিহারা শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি না পেলেও তাঁর ভাষণে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গ ফলাও করে উঠে এসেছে। মোদী বলেছেন, ‘‘দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সবচেয়ে কুপ্রভাব যুবসমাজের উপরে পড়ে, গরিব আর মধ্যবিত্তের উপরে পড়ে। দুর্নীতির প্রভাব কী ভাবে পড়ে, তা আমরা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেখেছি।’’ প্রধানমন্ত্রীর কথায়, ‘‘হাজার হাজার শিক্ষককে শেষ করে দিয়েছে, তাঁদের পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে, তাঁদের সন্তানদের অসহায় করে দিয়েছে। এটা শুধু কয়েক হাজার শিক্ষকের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা নয়। পশ্চিমবঙ্গের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।’’ এর পরেই মোদীর তোপ, ‘‘এত বড় পাপ তৃণমূলের নেতারা করেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও নিজেদের ভুল মানতে রাজি নন। উল্টে দেশের বিচারব্যবস্থাকে দোষী বানাচ্ছেন।’’

দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে চা বাগান শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধি (প্রভিডেন্ট ফান্ড) নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘পিএফ নিয়ে যা হয়েছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। গরিবের মেহনতের কামাইয়ের উপরে ডাকাতি করা হচ্ছে। তৃণমূলের সরকার দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।’’ তৃণমূল সরকারের ভুল নীতির কারণে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হচ্ছে এবং শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন বলে মোদী বৃহস্পতিবার অভিযোগ তুলেছেন।

একাধিক কেন্দ্রীয় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে চালু হতে দেওয়া হয়নি বলে আরও এক বার অভিযোগ করেছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতি নিজের জায়গায় রয়েছে। কিন্তু গরিব, দলিত, আদিবাসী এবং মহিলাদের সঙ্গে তৃণমূল কেন শত্রুতা করছে? এসসি, এসটি, গরিব এবং মহিলাদের জন্য সারা দেশে যে সব প্রকল্প চলছে, সেগুলোকে এখানে কার্যকরীই হতে দেয় না।’’ পশ্চিমবঙ্গে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প কার্যকরী না হওয়ায় এ রাজ্যের বাসিন্দাদের দিল্লি, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুতে গিয়ে নিখরচায় চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পেতে হয় বলে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। দেশের সত্তরোর্ধ্ব সব নাগরিককে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসাকেন্দ্র নিখরচায় দিচ্ছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ নাগরিকদের সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত রাখা হয়েছে বলে মোদীর অভিযোগ।

যে এলাকায় বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সভা হয়েছে, সেই আলিপুরদুয়ার-সহ গোটা উত্তরবঙ্গে আদিবাসী জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য। প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূলকে আক্রমণ করতে গিয়ে মোদী ‘আদিবাসী তাস’ বার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘২০২২ সালে এনডিএ যখন এক আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করল, তখন সর্বাগ্রে বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল। বাংলার আদিবাসী সমাজের প্রতি তৃণমূলের কোনও সহানুভূতি নেই।’’ কয়েক দিন আগে নয়াদিল্লিতে নীতি আয়োগ পরিচালন পর্ষদের য়ে বৈঠক হয়েছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল শুধু রাজনীতিই করতে চায়। উন্নয়ন চায় না। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন তৃণমূলের কাছে অগ্রাধিকার নয়।’’

তৃণমূলকে আক্রমণের পর্ব শেষ করে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পর্বে প্রবেশ করেন মোদী। বাংলার সঙ্গে ‘অপারেশন সিঁদুরে’র সম্পর্ক কতটা ‘ঘনিষ্ঠ’, তা বোঝানোর চেষ্টায় বলেন, ‘‘আজ যখন সিঁদুরখেলার এই মাটিতে এসেছি, তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের নতুন ভূমিকার কথা উঠে আসা স্বাভাবিক।’’ মোদীর কথায়, ‘‘আমাদের বোনেদের সিঁদুর ওরা মুছেছিল। আমাদের সেনা ওদের আমাদের সিঁদুরের শক্তি বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা সন্ত্রাসের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছি, যা পাকিস্তান কল্পনাও করতে পারেনি।’’

পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মুখে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের নামও শোনা গিয়েছে। ১৯৭১ সালের কথা মনে করিয়ে মোদী বলেন, ‘‘আজকের বাংলাদেশে যে রকম সন্ত্রাস পাকিস্তান করেছিল, পাকিস্তানের সেনা বাংলাদেশে যে পরিমাণে ধর্ষণ আর খুন করেছিল, তা কেউ ভুলতে পারে না। সন্ত্রাস আর নরসংহার পাকিস্তানের সেনার সবচেয়ে বড় দক্ষতা।’’ পাশাপাশিই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘সরাসরি যুদ্ধ হলেই পাকিস্তানকে শোচনীয় ভাবে হারতে হয়। তাই ভারতের সঙ্গে ওরা সরাসরি যুদ্ধ করতে চায় না, সন্ত্রাসবাদীদের দিয়ে ভারতের ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার পরে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, সন্ত্রাসী হামলা হলে পাকিস্তানকে তার চড়া দাম দিতে হবে। তিন বার পাকিস্তানকে ঘরে ঢুকে মেরেছি।’’ বাংলার মাটিতে শক্তির আরাধনার কথাও এসেছে মোদীর মুখে। বলেছেন, ‘‘আমরা শক্তির পূজা করি। আমরা মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা করি। বাংলার বাঘের (রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার) ভূমি থেকে ১৪০ কোটি ভারতবাসীর সঙ্কল্প, অপারেশন সিঁদুর এখনও শেষ হয়নি!’’

PM Narendra Modi BJP West Bengal BJP Bengal politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy