Advertisement
E-Paper

ফেসবুকে লেখার মাসুল ছাত্রের মার

ফেসবুকে পোস্ট করা মন্তব্যের জেরে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কোপে পড়লেন এক কলেজশিক্ষক। ঘাটালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক অমিত রায়কে মঙ্গলবার স্টাফরুমে ঢুকে মারধর করে এল তাঁর ছাত্ররা। অভিযোগের আঙুল এ বারও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দিকে। শাসক দলের সহনশীলতার অভাব এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের একের পর এক দৃষ্টান্ত তৃণমূল জমানায় আকছার দেখেছেন রাজ্যবাসী। কখনও সারের দাম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করায় জেলে যেতে হয়েছে বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরীকে, কখনও ব্যঙ্গচিত্র মেল করে হাতে হাতকড়া পড়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩২

ফেসবুকে পোস্ট করা মন্তব্যের জেরে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কোপে পড়লেন এক কলেজশিক্ষক। ঘাটালের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক অমিত রায়কে মঙ্গলবার স্টাফরুমে ঢুকে মারধর করে এল তাঁর ছাত্ররা। অভিযোগের আঙুল এ বারও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দিকে।

শাসক দলের সহনশীলতার অভাব এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের একের পর এক দৃষ্টান্ত তৃণমূল জমানায় আকছার দেখেছেন রাজ্যবাসী। কখনও সারের দাম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করায় জেলে যেতে হয়েছে বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরীকে, কখনও ব্যঙ্গচিত্র মেল করে হাতে হাতকড়া পড়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের। এলাকায় ধর্ষণ-খুন নিয়ে প্রশ্ন তুলে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজ বিগড়ে দেন কামদুনির টুম্পা-মৌসুমী কয়ালেরা। মুখ্যমন্ত্রীর নামে ফেসবুকে কটূক্তি করে ধৃত মালদহের বাপি পাল গোড়ায় আইনজীবী পর্যন্ত পাননি।

এরই পাশাপাশি, শিক্ষাঙ্গনে লাগাতার নৈরাজ্য এবং শিক্ষক-নিগ্রহের ঘটনাও এ রাজ্যে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিএমসিপি-র নেতৃত্ব থেকে শঙ্কুদেব পণ্ডার অপসারণেও যে ওই প্রবণতা বন্ধ হয়নি, এ দিন ঘাটালের ঘটনা সেটাই ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ক’দিন আগেই ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে শিক্ষায় নৈরাজ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলাতেই মার খান কাকদ্বীপের স্কুলশিক্ষক গৌতম মণ্ডল। এ দিন ঘাটালের কথা জেনে তিনি বলছেন, “আসলে শাসক দলের চোখে ও কানে কিছু সহ্য না হলেই এ ধরনের আক্রমণ নেমে আসছে।”

মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাবের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে শাসক দলের দাদাগিরির ভয়াবহ মিশেলই কলেজের স্টাফরুমে ঢুকে শিক্ষককে মারধর করার সাহস জোগাল বলে মনে করছেন শিক্ষাজগতের বড় অংশ। অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, স্টাফরুমে ঢুকে তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারছেন, এ দৃশ্য আগেই দেখেছিল এ রাজ্য। এ বার ছাত্ররাও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করল।

গত ২৯ জানুয়ারি দুই মেদিনীপুরের সব কলেজের সঙ্গেই ভোট ছিল ঘাটাল কলেজে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদ দখল করে টিএমসিপি। মনোনয়ন পর্ব চলাকালীনই গত ১৬ এবং ২১ জানুয়ারি বামপন্থী শিক্ষক সংগঠন ‘ওয়েবকুটা’র সদস্য অমিতবাবু নিজের ফেসবুক ওয়ালে কিছু মন্তব্য করেন। ১৬ তারিখ তিনি লেখেন “আজ কলেজে ছাত্র সংসদ নিবার্চনে মনোনয়ন তোলার প্রথম দিন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কলেজের এন্ট্রান্স গেটগুলিতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে টিএমসিপি ছাড়া আর অন্য কেউ মনোনয়নপত্র তোলার জন্য ঢুকতে না পারে। অনেক ছেলে বুকে কলেজের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে ঘুরছে। তারা ছাত্র না বহিরাগত, জানা যায় না। কলেজ নির্বাচন বিনা লড়াইয়ে জেতার অদম্য প্রয়াস। আমাদের কলেজের ইতিহাসে ২০১১ সালের আগে এ রকম দেখিনি। গণতন্ত্র জিন্দাবাদ।”

২১ তারিখ ফের ওই শিক্ষক ফেসবুক-দেওয়ালে ফের মন্তব্য করেন, “নির্বাচন হল না। কোনও ছাত্রকে কলেজে ঢুকতে দেওয়া হল না। পাছে কেউ মনোনয়ন পেশ করে দেয়। যারা এসেছিল মিছিল করে, তাদেরও ঢুকতে দেওয়া হল না। কলেজ টিএমসিপি-র, পুলিশ টিএমসি-র, টিআইসি (টিচার-ইন-চার্জ) হয়ে গিয়েছে তৃণমূল ইন-চার্জ।”

কলেজ সূত্রের খবর, এ দিন দুপুরে স্টাফ-রুমে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন অমিতবাবু। তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, “হঠাত্‌ টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হেমন্তকুমার দাস আমাকে বাইরে ডাকেন। গিয়ে দেখি, শুধু হেমন্ত নন, জনা কুড়ি

ছাত্রও রয়েছে। ফেসবুক পেজের প্রতিলিপি নিয়ে ওরা জানতে চায়, কেন ওই সব মন্তব্য পোস্ট করেছি। আমি বলি, ব্যক্তিগত মতামতের ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য নই।”

অভিযোগ, এর পরেই হেমন্তের নেতৃত্বে অমিতবাবুকে কিল, ঘুষি মারা শুরু হয়। ছিঁড়ে দেওয়া হয় তাঁর সোয়েটার। ইতিহাসের শিক্ষক রাজেশ ঘোষের বিস্ময়, “ক্লাস সেরে স্টাফ-রুমে আসার সময় দেখি অমিতবাবুকে মারধর করা হচ্ছে! থামাতে গেলে আমাকেও ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়!” হতবাক অমিতবাবু স্টাফ-রুমে ফিরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও হতভম্ব হয়ে যান। অভিযোগ, এই সময় ফের দলবল নিয়ে স্টাফ-রুমে ঢোকে হেমন্ত। অমিতবাবুকে এ বার চেয়ার থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়।

ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন ক্লাস বয়কট করেন শিক্ষকেরা। কলেজ শিক্ষক আব্দুল মতিন, কপোতাক্ষী শূর, শর্মিষ্ঠা রায়দের বক্তব্য, “দোষীরা গ্রেফতার না হলে এবং কলেজে সুস্থ পরিবেশ না ফিরলে আমরা ক্লাসে যাব না।” ‘ওয়েবকুটা’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ জানান, আজ, বুধবার পশ্চিম মেদিনীপুরের সব কলেজেই কালো ব্যাজ পরে ধিক্কার জানাবে সংগঠন। তাঁর অভিযোগ, “রাজ্যে গণতন্ত্র আছে বলে মনে হয় না। অম্বিকেশ থেকে অমিত তারই প্রমাণ।” টিএমসিপি নেতা হেমন্ত ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে ঘাটাল থানায় অভিযোগ করেছেন অমিতবাবু। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “অভিযোগের তদন্ত চলছে।”

ঘটনাচক্রে সোমবারই কলকাতার নজরুল মঞ্চে এ বছরের টেলিসম্মান প্রদান অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী সহনশীলতার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, “সব কিছু শুনতে হয়, ভাল-খারাপ মিশিয়ে। এটাই গণতন্ত্র।” দলনেত্রীর পরামর্শ যে বাস্তবে মানা হয়নি, এ দিনের ঘটনাই তার প্রমাণ। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা তথা বিধায়ক মানস ভুঁইয়া তাই বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে বলছি, আপনি মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন। কাজে আপনার ছেলেরাই করে উল্টো।” আবার সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মতে, “দাদাদের কাছ থেকে যা শিখছে, টিএমসিপি-র কর্মীরা তাই করছে।” বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, “অসংবেদনশীল ও হিংস্র রাজনীতি ছাত্রসমাজকে গ্রাস করেছে। এই জমানায় ছাত্র ও শিক্ষকের স্বাভাবিক সম্পর্কও নষ্ট হতে বসেছে।”

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য ঘাটালের ঘটনা সমর্থন করেননি। তিনি বলেছেন, “শিক্ষকের গায়ে ছাত্রেরা যদি হাত তোলে, তারা যে দলের সঙ্গেই যুক্ত হোক না কেন কঠোর শাস্তি প্রাপ্য।” তবে সেই সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর সংযোজন, “ওই শিক্ষক কি কলেজে টিচার ইন-চার্জকে কিছু জানিয়েছেন? শুধু সংবাদমাধ্যমে হইচই না করে নিয়মমাফিক অভিযোগ করলে খোঁজ নিতেও সুবিধা হয়।” টিচার ইন-চার্জ লক্ষ্মীকান্ত রায়ের প্রতিক্রিয়া, “আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানেই সব শুনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” তবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনও রকম গোলমালের অভিযোগ মানেননি তিনি। তৃণমূলের মহাসচিব হিসেবে পার্থবাবু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায়কে ঘটনাটি নিয়ে শীঘ্র রিপোর্ট দিতে বলেছেন। গোলমাল যে একটা হয়েছে, তা মানছেন হেমন্তও। তবে তাঁর দাবি, “মারধরের অভিযোগ ঠিক নয়। কেন ফেসবুকে ওই সব লিখেছেন, তা জানতে চাওয়ায় স্যারই আমাকে ঠেলে ফেলে দেন। তখন ধস্তাধস্তি হয়।”টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র দাবি করছেন, “শিক্ষককে হেনস্থার কোনও ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ পাহারায় স্বচ্ছ ভাবেই ওই কলেজে মনোনয়ন পর্ব মিটেছিল। উনি সিপিএম করেন বলেই ক্ষোভে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।”

ghatal beaten by student teacher beaten tmcp facebook
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy