Advertisement
E-Paper

আমরা কি দেখার জিনিস! ক্ষোভ আর্সেনিক-আক্রান্তের

প্রকল্প-পরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু আর্সেনিক দূষণ কি ঠেকানো গিয়েছে? কেমন আছেন আক্রান্তেরা?

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৮ ০৪:১৫
কল্যাণপুরে আক্রান্ত। —নিজস্ব চিত্র।

কল্যাণপুরে আক্রান্ত। —নিজস্ব চিত্র।

বেড়া দেওয়া মাটির ঘর। কাছে যেতেই কানে আসে গোঙানি। এগোতেই বাধা দিলেন বৃদ্ধা আকলিমা বিবি। চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘কী দেখতে এসেছেন? আমরা কি দেখার জিনিস! মানুষটা দিনরাত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কেউ কিচ্ছু করেনি।’’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। ঘরের ভিতরে তাঁর স্বামী, ৮০ বছরের হাবিবুল্লা মল্লিকের গোঙানিটাও তীব্র হয়। পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ ব্লকের কল্যাণপুরে হাবিবুল্লার মতো অনেকেই ধুঁকছেন আর্সেনিকের বিষে।

এ গ্রামের জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক মিশে থাকার কথা প্রথম ধরা পড়ে ২০০৫ সালে। পরপর মৃত্যু হয় কয়েক জনের। গ্রামবাসীদের ক্ষোভ, ২০১৪ সালে পঞ্চায়েতে চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়, আর্সেনিকোসিসে (আর্সেনিক থেকে হওয়া রোগ) মৃত্যুর সংখ্যা চল্লিশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। আক্রান্তদের নামের তালিকা দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থার দাবি তোলা হয়। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। হয়নি গ্রামবাসীর জন্য পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থাও।

প্রায় ১৬০ পরিবারের গ্রামে ছাবিরুদ্দিন মল্লিক, আজিদা বিবি, হামিদ মল্লিক, জিয়াউদ্দিন মল্লিকদের কারও স্মৃতি হারিয়েছে, কারও ঘর উজাড় হয়েছে, কারও হাত-পায়ের আঙুল কাটা পড়ছে। কেউ সারা গায়ে কালো ছিট দাগ বা দগদগে ঘা নিয়ে বেঁচে আছেন। গ্রামবাসীদের দাবি, প্রশাসনের নানা স্তর থেকে আর্সেনিক আক্রান্তদের বিশেষ চিকিৎসা, তাঁদের ভাতা দেওয়া, গ্রামে আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের নলকূপ বসানোর আশ্বাস মিলেছে বহু বার।

জলে বিষ

• দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিক মিশ্রিত জল খেলে পেটের অসুখ, ঘনঘন সর্দি-কাশি, রক্তাল্পতা, স্নায়বিক দুর্বলতা, হৃদরোগ, মূত্রাশয়ের রোগ, লিভার-ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে।

• গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান ছোট, অপরিণত বা বিকলাঙ্গ হতে পারে।

• মহিলাদের গর্ভপাতও হয়ে যেতে পারে।

বছর আটেক আগে কল্যাণপুর থেকে কিলোমিটার ছয়েক দূরে কোমলনগরে একটি আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের প্রকল্প তৈরি হয়। এলাকার বেশির ভাগ মৌজায় সেখান থেকেই বিশুদ্ধ পানীয় জল যায়। কল্যাণপুরে পাইপলাইন পাতা হলেও পরিস্রুত জল আসেনি। অথচ, এ গ্রামের উপর দিয়েই অন্য পাইপে কোমলনগর প্রকল্প থেকে জল যায় সরডাঙা গ্রামের জলাধারে।
পুলিশ-প্রশাসনের অভিযোগ, পাইপ ফাটিয়ে অপরিশোধিত সেই জলই ‘চুরি’ করা হয় কল্যাণপুরে। তা রুখতে গ্রামে গিয়ে বহু বার গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে ফিরতে হয়েছে পুলিশ বা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের আধিকারিকদের।

‘‘আমাদের ক্ষোভ থাকবে না?’’—প্রশ্ন করেন গ্রামবাসী মাসুদ শেখ। নথির তাড়া হাতে নিয়ে তিনি দাবি করেন, ২০০৫ সালের ২৪ জুন তৎকালীন মহকুমাশাসক (কালনা) পূর্বস্থলী ২ ব্লক প্রশাসন এবং পঞ্চায়েত সমিতিকে নির্দেশ দেন (‌মেমো নম্বর-৫২৩) কল্যাণপুর গ্রামে দু’টি আর্সেনিক-মুক্ত নলকূপ বসাতে। বরাদ্দ হয় ১ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা। কিন্তু অজানা কারণে সে কাজ শুরুই হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও চুরিই ঠিক নয়। কিন্তু কেন লোকে অপরিশোধিত ঘোলা জল চুরি করে খাচ্ছে, সেটা কি এক বার ভেবে দেখা যায় না?’’

বর্তমান মহকুমাশাসক নীতীশ ঢালির আশ্বাস, কেন এখনও ওই গ্রামের মানুষ সরাসরি আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের প্রকল্প থেকে জল পান না, তা জানতে পুরনো নথি দেখা হবে। জেলার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের আশ্বাস, ‘‘কোথায় সমস্যা, দ্রুত খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

আকলিমাদের অবশ্য তাতে ভরসা নেই। আর্সেনিক-আক্রান্ত বৃদ্ধার কথায়, ‘‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’’

Arsenic Purbasthali আর্সেনিক
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy