বিধানসভার প্রথম দিনে। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে কুশল বিনিময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবি: সুদীপ আচার্য।
তৃণমূলের সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পরে নতুন বিধানসভায় রাজ্যপালের প্রথম ভাষণেই ‘মা-মাটি-মানুষে’র জয়ের ভূয়সী প্রশংসা শোনা গেল। বলা হল, বিধানসভা ভোটে রাজ্যের মানুষ কুৎসার রাজনীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। রাজ্যপালের এমন ভাষণ শুনে বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকে দিয়ে সরাসরি শাসক দলের রাজনৈতিক বক্তব্যই বলিয়ে নেওয়া হয়েছে!
বিধানসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে শুক্রবার রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর ভাষণের মধ্যে দিয়ে। রাজ্যপালের এ বারের লিখিত ভাষণ সাম্প্রতিক কালের মধ্যে হ্রস্বতম! মাত্র কয়েক পাতার সেই ভাষণে রাজ্যপাল বলেছেন, ‘গভীর সন্তোষের সঙ্গে উল্লেখ করছি যে, পশ্চিমবঙ্গের ষোড়শ বিধানসভা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জনসাধারণের রায় বিপুল ভাবে মা-মাটি-মানুষের সরকারের পক্ষেই গিয়েছে’। পরে আরও বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন পরবর্তী চূড়ান্ত ফলাফল থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাজ্যের ভোটদাতারা দ্বিধাহীন ভাবে সুশাসন ও স্থায়ী উন্নয়নের পক্ষে রায় দিয়েছেন। মানুষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত কুৎসা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার রাজনীতিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন’।
নিয়ম অনুযায়ী, রাজ্য মন্ত্রিসভাই রাজ্যপালের ভাষণ তৈরি করে দেয়। রাজ্যপালকেও ‘আমার সরকার’ বলে উল্লেখ করে লিখিত ভাষণ পাঠ করতে হয়। সরকারের কাজের প্রশংসা যে রাজ্যপালের বক্তৃতায় থাকবে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু এ বার বিতর্ক বেধেছে ভোটের সময়ে এবং পরে তৃণমূলের রাজনৈতিক সুরের সঙ্গে রাজ্যপালের বক্তব্য মিলে যাওয়ায়! দুর্নীতি ও অপশাসনের একের পর এক অভিযোগ নিয়ে ভোট-বাজারে বিরোধীরা যখন সরব, সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য ছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা করা হচ্ছে। ভোটে বিপুল আসন পেয়ে জেতার পরেও তিনি বলেছেন, কুৎসার বিরুদ্ধে একা লড়ে এই জয় এসেছে। এখন রাজ্যপালের
মুখে সেই কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছে বিরোধীরা।
বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের কথায়, ‘‘কুৎসা বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তার ব্যাখ্যা এখানে নেই। কিন্তু প্রচারে আমরা যা বলেছি, সব কি মিথ্যা ছিল? ভোটে জিতলেই সততা প্রমাণ হয় না! অনেক চোর-ডাকাতও ভোটে জিতে সাংসদ বা বিধায়ক হয়!’’ নিহত সাংসদ ফুলন দেবীর উদাহরণ উল্লেখ করেছেন মান্নান। সেই সঙ্গেই প্রশ্ন তুলেছেন, গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়া ঘুষ-কাণ্ডের তদন্ত বা বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিতদের টাকা ফেরানোর ব্যাপারে কোনও প্রতিশ্রুতি রাজ্যপালের ভাষণে থাকল না কেন?
বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এটা তৃণমূলের ভাষণ না অন্য কিছু, বিধানসভার মধ্যে আলোচনায় আমরা বলব। রাজ্য জুড়ে যে বিরোধীদের উপরে আক্রমণ চলছে, আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি হয়েছে, সে সবেরও কোনও উল্লেখ ভাষণে নেই। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার এ সব দেখতে চায় না! কেউ যদি মনে করে মানুষের বক্তব্যকে অস্বীকার করে নিজের মতো চলবে, তা হলে রাস্তাই একমাত্র রাস্তা!’’ ঘটনাচক্রে, রাজ্যপাল যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি, সেই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিও এ রাজ্যের নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-সহ নানা অভিযোগে সরব ছিল। তবে শিলিগুড়িতে দলের রাজ্য কমিটির বৈঠক থাকায় রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ-সহ বিজেপি বিধায়কেরা এ দিন বিধানসভায় ছিলেন না।
শুধু কুৎসাকে পরাস্ত করে মা-মাটি-মানুষের জয়ই নয়, নির্বাচনী আচরণবিধি জারি থাকায় সরকারের আগের মেয়াদের কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্প আটকে ছিল বলেও রাজ্যপালের ভাষণে বলা হয়েছে। বিরোধীদের মতে, ভোট থাকলে আচরণবিধি তো জারি হবেই! আসলে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তৃণমূলের জেহাদের সুরই এখানে চলে এসেছে বলে বিরোধী নেতারা মনে করছেন। রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী বা সবুজসাথী প্রকল্পের কথা বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে রাজ্যপালের ভাষণে। রাজ্য সরকার গত পাঁচ বছরে তরুণ প্রজন্মের লক্ষ্যপূরণে প্রয়াসী ছিল, এমনও বলেছেন রাজ্যপাল।
মান্নান-সুজনদের প্রশ্ন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো জ্বলন্ত সমস্যা বা ভোট-পরবর্তী হিংসার কোনও নামোল্লেখ না করে শুধু সরকারের প্রশংসাতেই কেন শেষ হয়ে গেল রাজ্যপালের ভাষণ? মান্নান এই ভাষণকে সরাসরিই ‘দিশাহীন’ বলে আক্রমণ করেছেন। যদিও সরকার পক্ষ এই সমালোচনাকে আমল দিতে নারাজ। পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘রাজ্যপালের ভাষণে যা সত্য, তা-ই বলা হয়েছে। কিছু বলার না পেয়ে বিরোধীরা শুধু ‘গ্যালারি শো’ করছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy