কর্মী তালিকায় নাম আছে। মাসে মাসে সেই বাবদ বেতনও দেয় সরকার। কিন্তু হাসপাতালে তাঁর দেখা মেলে না। তাঁর হয়ে মাসে বারকয়েক আসেন তাঁর ছেলে। এক দিন এসে বেশ কয়েক দিনের সই করে চলে যান। হাসপাতালে কম-বেশি সকলেই জানেন সে কথা। কিন্তু প্রতিবাদ করার কথা ভাবেননি কেউই। কলকাতার এক নামী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য দফতরে এই অভিযোগ পাঠান তিতিবিরক্ত এক জুনিয়র ডাক্তার। বেশ কিছু দিন সেই চিঠি টেবিলে পড়ে ধুলো খাওয়ার পরে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। কারণ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের নানা ধরনের উৎপাত প্রায় সব হাসপাতালেই।
এমনিতেই সরকারি হাসপাতালে গ্রুপ ডি কর্মীর বহু পদ খালি পড়ে রয়েছে। তার উপরে আবার যাঁরা আছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই কাজ করেন না। ফলে রোগী ভোগান্তির ছবিটা সর্বত্রই প্রকট। ডাক্তার-নার্সরা অবশ্য বলছেন, শুধু রোগীদের নয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের দাপটে প্রতি পদে অসুবিধায় পড়তে হয় তাঁদেরও। বহু সময়েই রোগী পরিষেবার একাধিক কাজ আটকে থাকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের জন্যই। সদ্য ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনার পরে হাসপাতালের যে যে পরিস্থিতি বদলের জন্য তাঁরা লিখিত আবেদন করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের দৌরাত্ম্য।
ক্ষমতায় এসে স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের নাম দিয়েছিলেন ‘কর্মসাথী’ ও ‘কর্মবন্ধু’। জানিয়েছিলেন, প্রতি দিনের পরিষেবায় এঁরা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভরসাকে কার্যত অগ্রাহ্য করেই দিনের পর দিন যথেচ্ছাচার চালিয়ে যাচ্ছেন এঁরা। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘সাফাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে রোগীকে ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া, ডাক্তারদের কলবুক নিয়ে যাওয়া, রক্ত-মূত্র প্রভৃতির নমুনা প্যাথোলজিতে নিয়ে যাওয়া, ট্রলি-স্ট্রেচার ঠেলা, অপারেশন থিয়েটারে নানা ফাইফরমাশ খাটা-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার কথা গ্রুপ ডি কর্মীদের। কিন্তু বাস্তবে এই সব কাজের সময়ে বহু ক্ষেত্রেই ওঁদের দেখা পাওয়া যায় না। তাই রোগীকে পাঁজাকোলা করে ওয়ার্ডে ছোটেন বাড়ির লোক, রক্ত-মূত্রের নমুনা নিয়েও তাঁদেরই ছুটতে হয়। মাসের পর মাস বেতন গুণেও দোষী হয় সরকার।’’
কী ধরনের ভোগান্তি হয় গ্র্ুপ ডি কর্মীদের জন্য? এসএসকেএমের এক কর্তা বলেন, ‘‘অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার চলাকালীন রোগীর পরিজনদের থেকে খবর দেওয়া বাবদ টাকা আদায় করেন কয়েক জন। এ নিয়ে লিখিত অভিযোগে আমরা জেরবার। বহু বার ওই কর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। লাভ হয়নি। তাড়াতেও পারছি না। কারণ তাড়াতে গেলে আন্দোলন হবে। তা ছাড়া এমনিতেই কর্মী কম, ক’জনকে তাড়াব?’’
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ট্রলি চক্র চালানোর অভিযোগ রয়েছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বিরুদ্ধে। ট্রলি পিছু ১০০ টাকা করে দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন বহু রোগীর পরিবার। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে এক প্রসূতিকে ট্রলিতে করে স্ত্রী-রোগ বিভাগে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। মাঝপথে টাকা নিয়ে গোলমাল হওয়ায় তাঁকে নামিয়ে দেন ওই কর্মী। কাতরাতে থাকেন মহিলা। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে হাজির অন্য এক রোগীর পরিবারের লোকেরা রুখে দাঁড়ালে ফের প্রসূতিকে ট্রলিতে তোলা হয়। এ নিয়ে এনআরএসেও লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সকলেই খারাপ নন। তবে কিছু কিছু কর্মীকে নিয়ে নানা অভিযোগ আসছে। আমরা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছি। মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ আছে, রোগী পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটালে, তা সে যাঁরাই হোন না কেন, তাঁদের ছেড়ে কথা বলা হবে না।’’
শুধু সরাসরি নিয়োগ হওয়া সরকারি কর্মী নয়, ঠিকাদারের অধীনে চুক্তির ভিত্তিতেও হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগ করা হয়। আরেকটি ইউনিয়নের তরফে বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘যে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের পাকা চাকরি, তাঁরা নানা রকম সমস্যা তৈরি করতে পারেন। এমনকী বকলমে হাজিরাও দিতে পারেন। কাজ না করে সময় কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু চুক্তির ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা এগুলো করেন না। পরিষেবা টিকিয়ে রাখার পিছনে তাঁদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।’’
তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগের পাহাড় জমছে, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল চতুর্থ শ্রেণির স্থায়ী সরকারি কর্মীদের ইউনিয়নগুলিও। প্রোগ্রেসিভ এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতা, এসএসকেএমের এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বলেন, ‘‘চতুর্দিকে এত অভিযোগ উঠছে সেটা আমরাও জানি। আমরাও এর প্রতিকার চাইছি। নোটিস দেওয়া হয়েছে, খারাপ কাজের দায়িত্ব প্রত্যেকের নিজের। তার দায় ইউনিয়ন নেবে না। কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নেবে তা মেনে নেওয়া হবে।’’
এই মুখের কথা, কাজে পরিণত হয় কি না, আপাতত সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy