পাড়াপ্রতিবেশীরা আড়ালআবডালে তাঁর নিন্দেমন্দ করলেও গায়ে মাখাননি। এ ধরনের ‘কাজ’ তাঁদের ধর্মে নেই, এমন কথাও শুনতে হয়েছে। তবে কোনও কিছুকেই আমল দেননি গিয়াসুদ্দিন আনসারি। নিজের কাছে তাঁর একটাই পরিচয়— তিনি ছৌশিল্পী।
গত ২৮ বছর ধরে হিন্দু দেবদেবীর ভূমিকায় ছৌনৃত্য করে চলেছেন পুরুলিয়ার বরাবাজারের পলমার বাসিন্দা গিয়াসুদ্দিন। ধর্মীয় ভেদাভেদের প্রশ্ন তুলে হানাহানির ঘটনায় যখন আকছার অশান্তির পরিবেশ তৈরি করা হয়, সে সময় গিয়াসুদ্দিনের কাহিনি অন্য মাত্রা পায় বলেই মনে করেন অনেকে।
ছৌশিল্পী হিসাবে দীর্ঘ যাত্রাপথটি মোটেও সহজ ছিল না। বাধাবিপত্তি কাটিয়েও এগিয়ে চলেছেন গিয়াসুদ্দিন। কখনও কৃষ্ণ অথবা সখীর ভূমিকায় তো কখনও তিনি সেজেছেন কার্তিক কিংবা অসুর। এ সব করতে গিয়ে নিন্দার ভাগীদারও হতে হয়েছে গিয়াসুদ্দিনকে। তিনি বলেন, ‘‘অনেকে আমাকে খারাপ বলেছেন। সামনে না বললেও পেছনে আমার সমালাচনা করেছেন। অনেকে এ-ও বলেছেন যে এগুলো আমাদের ধর্মে নেই। তাই এমন নাচ করা উচিত নয়। কিন্তু, কোনও কিছুতেই আমল দিইনি। শুধু একটাই কথা ভেবে নিয়েছিলাম, সব বাধা অতিক্রম করে আমাকে শিল্পী হতে হবে। কারণ, এই ছৌ নৃত্য পুরুলিয়ার গর্ব!’’
আরও পড়ুন:
ছৌশিল্পী গিয়াসুদ্দিন আনসারি। —নিজস্ব চিত্র।
নিবিষ্ট মনে শিল্পের সেবা করার ফলও পেয়েছেন গিয়াসুদ্দিন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম বা কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধীর সামনে ছৌনৃত্য পরিবেশন করে পুরস্কৃত হয়েছেন। তবে অর্থকরী দিক থেকে যে অত্যন্ত লাভবান হয়েছেন, এমনটা নয়। স্কুলে পড়ার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের মাসিক ১৫০ টাকা বৃত্তি পেতেন। আজকাল রাজ্য সরকারের শিল্পীভাতা পান। তা সত্ত্বেও ছৌ নাচের একটি দলও গড়ে ফেলেছেন। পলমা শক্তি সংঘ নামক ওই দলে ৩২ জন সদস্য। গিয়াসুদ্দিন বলেন, ‘‘আমার নাচের দলে ছ’জন ছাড়া সকলেই হিঁদু পরিবারের। কিন্তু অনেকেই আমার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করেন। কখনও অসুবিধা হয়নি।’’
নিজের ধর্মীয় পরিচয় ভোলেননি গিয়াসুদ্দিন। তবে নাচের মঞ্চে উঠলে তাঁর পরিচয় একটাই— তিনি ছৌশিল্পী। গিয়াসুদ্দিনের কথায়, ‘‘আমার ধর্ম আমার নিজের জায়গায়। তবে যখন মঞ্চে উঠি, তখন সব ভুলে যাই। তখন আমি শুধুই ছৌশিল্পী। লোকের কথা গায়ে মাখি না। আমার পূর্বপুরুষেরাও ছৌনাচ করতেন। সত্যি বলতে কি আমি জাতিগত ভেদাভেদ মানি না। একটাই জাতের কথা জানি, তা হল মানবজাতি!’’