রাজিনা খাতুনের বয়স মাত্র ১৬ মাস।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজার ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম রামচন্দ্রপুরের রিজওয়ান মোল্লা মেয়েকে নিয়ে গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। মেয়ের সমস্যা, সে হাঁটা শেখেনি এই বয়সেও। ধরে দাঁড়াতেও শেখেনি। পাশ থেকে মা সামশুনাহার বিবি জানালেন, কিছু খাচ্ছেও না শিশুটি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার মেয়েটিকে দেখে জানালেন, গুরুতর অপুষ্টির শিকার রাজিনা। যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে, ‘সিভিয়ারলি ম্যালনারিশ্ড’।
শুধু রাজিনাই নয়, ধনুরহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে শিশুদের অপুষ্টির ছবিটা প্রায় এই রকমই। স্থানীয় স্বেচ্ছ্বাসেবী সংগঠন ‘সুন্দরবন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের কর্মীদের চেষ্টায় ছবিটা ধীরে ধীরে কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি জাতীয় সমীক্ষা বলছে, শিশুদের অপুষ্টির বিবর্ণ ছবিতে রং ফিরতে এখনও অনেকটাই বাকি!
প্রায় দশ বছর পরে গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে, ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে’ (এনএফএইচএস)-এর রিপোর্ট। দেশের ১৩টি রাজ্য ও দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের শিশু-স্বাস্থ্যের যে ছবি সেই সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে, ২০০৫-’০৬- এর তুলনায় তা কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও, উল্লসিত হওয়ার মতো কিছু নয়। সদ্যোজাত শিশু-মৃত্যুর হার ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু-প্রতিরোধের হারে পশ্চিমবঙ্গ যে জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে, সেটা অবশ্যই খুশির খবর। শিশুদে্র টিকাকরণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে এই রাজ্যে। কিন্তু শিশু ও প্রসূতিদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টির খতিয়ান পশ্চিমবঙ্গে এখনও রীতিমতো উদ্বেগজনক।
মন্দিরবাজারে শিশুদের ওজন মাপা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, এই রাজ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের অর্ধেকের বেশি এখনও রক্তাপ্লতা (অ্যানিমিয়া)-র শিকার। প্রসূতিদেরও অর্ধেকের বেশি ভুগছেন রক্তাপ্লতায়। ২০০৫-’০৬- এ যেখানে এই রাজ্যে রক্তাপ্লতায় আক্রান্ত শিশু ছিল ৬১ শতাংশ, গত দশ বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে ‘উন্নতি’ বলে মনে হলেও, তার সঙ্গে একমত নন পুষ্টি-বিশেষজ্ঞ ও শিশু অধিকার কর্মীরা। কারণ, দশ বছরে ওই হার কমেছে মাত্র সাত শতাংশ! মানে, বছরে ০.৭ শতাংশ হারে! তাঁদের মতে, এই রাজ্যে প্রসূতিদের ৫৩ শতাংশই রক্তাপ্লতার শিকার। তথ্য আরও বলছে, গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আয়রন ও ফোলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খেয়েছেন, প্রসূতিদের মাত্র ২৮ শতাংশ। তাই এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকছে যে, মায়েদের রক্তাপ্লতা বর্তাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের ওপরেও। শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিই সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ। তার মানে, ‘সাইকেল অফ ম্যালনারিশমেন্ট’কে এই রাজ্যে পুরোপুরি রুখে দেওয়া গত দশ বছরে সম্ভব হয়নি।
জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য জানাচ্ছে, শিশুদের অপুষ্টির প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গত দশ বছরে সামান্য অগ্রগতি হলেও, এখনও এই রাজ্যের সার্বিক চিত্রটি খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বয়সের তুলনায় ওজন কম (আন্ডার-ওয়েট), এই রাজ্যে এমন শিশু এখনও ৩১.৫ শতাংশ। যা দশ বছর আগে ছিল ৩৮ শতাংশ। বয়সের তুলনায় উচ্চতার আশানুরূপ বৃদ্ধি ঘটেনি (স্টান্টিং), এমন শিশু এই রাজ্যে ৩২.৫ শতাংশ। দশ বছর আগে যা ছিল ৪৪ শতাংশ। উচ্চতার তুলনায় ওজন আশানুরূপ বাড়েনি, এমন শিশুর সংখ্যা আবার গত দশ বছরে কিছুটা বেড়ে গিয়েছে! ১৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০.৩ শতাংশ!
ধনুরহাট গ্রাম পঞ্চায়েতে চলছে টিকাকরণ। সৌজন্যে-ক্রাই।
জন্মের পর প্রথম দু’বছরে মাতৃস্তন্য পেয়েছে, এমন শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়েনি পশ্চিমবঙ্গে। জাতীয় সমীক্ষা বলছে, ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের মাত্র ৫২ শতাংশ শুধু মাতৃস্তন্যের ওপরেই নির্ভর করেছে। বাকিদের পুষ্টির জন্য অন্য দুধ বা খাদ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আর, জন্মের পর প্রথম ঘণ্টায় মায়ের দুধ পেয়েছে মাত্র ৪৭ শতাংশ শিশু। কুসংস্কার বা অন্য কোনও কারণে জন্মের পর প্রথম ঘণ্টায় ৫৩ শতাংশ শিশু মায়ের দুধ পায়নি। যা আরও উদ্বেগের, তা হল, দু’বছরের কম বয়সী শিশুদের মাত্র ১৯.৬ শতাংশ পেয়েছে যথাযথ পুষ্টিগুণের খাদ্য।
শিশুদের স্বাস্থের এই সব গুরুত্বপূর্ণ সূচকের নিরিখে বলা যায়, গত দশ বছরে শিশু ও প্রসূতিদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নতি হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা আশাব্যঞ্জক নয়।
একটি জাতীয় শিশু অধিকার সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা অতীন্দ্রনাথ দাসের মতে, ‘‘রাজ্য সরকারের তরফে শিশুদের অপুষ্টি প্রতিরোধে সদিচ্ছা ও উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসনীয় হলেও, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এখনও আমাদের অনেক পথ হাঁটা বাকি। সকলেই জানেন, সার্বিক ভাবে প্রসূতিদের পুষ্টি সুনিস্চিত করতে না পারা গেলে, শিশুদের অপুষ্টি প্রতিরোধ করা এক কথায় অসম্ভবই। যদিও তথ্য বলছে, প্রসূতিদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য আমরা এখনও পুরোপুরি সুরক্ষিত করে তুলতে পারেনি। সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, এই রাজ্যের ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েদের ৪০ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের নীচে। মানে, তারা গর্ভধারণের জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠার সময় পায়নি। এটা থেকেই স্পষ্ট যে, শিশুদের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা ততটা বাড়ানো যায়নি।’’
অতীনবাবু এ-ও বললেন, ‘‘সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও আইসিডিএস প্রকল্পের মাধ্যেমে অঙ্গনওয়াড়ি স্তরে পরিষেবা দেওয়া শুরু হয়েছিল ঠিক এই কারণেই। কিন্তু গত ২৫ বছরেও আমরা এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাইনি। বরং আইসিডিএস প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে।’’
তবে ভাল খবর হল, শিশু-মৃত্যু প্রতিরোধে গত দশ বছরে ত্রিপুরার সঙ্গে যুগ্ম ভাবে প্রথম স্থান দখল করেছে এই রাজ্যই। জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে শিশু-মৃত্যুর হার বেশ কম। টিকাকরণের ক্ষেত্রেও এই রাজ্য অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় যে অনেক এগিয়ে, সে কথাও অবশ্য উল্লেখ করা হয়েছে ওই জাতীয় সমীক্ষায়।
তথ্য বিশ্লেষণ: ক্রাই- চাইল্ড রাইট্স অ্যান্ড ইউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy