এক দিকে বিপর্যস্ত এলাকায় ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া। অন্য দিকে, দলের সাংসদ ও বিধায়কের উপরে হামলার জেরে জনমানসে সহানুভূতি। দু’য়ে মিলে ভোটের মাস ছ’য়েক আগে উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক রসায়ন বিজেপির জন্য একটু বেশিই ‘অনুকূল’ বলে মনে করছেন অনেকে। যদিও রাজ্য বিজেপি সূত্রের দাবি, উত্তরবঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগেই সেখানে দলের পরিস্থিতি নিয়ে সাংগঠনিক রিপোর্ট জমা পড়েছিল। তাতে ২০২১ সালের চেয়ে অনেক বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা তথ্য-সহ তুলে ধরা হয়েছে।
উত্তরবঙ্গে বিধানসভা আসন ৫৪টি। বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, ৪৪ থেকে ৪৮টিতে তৃণমূলকে ‘হারানোর পরিস্থিতি’ রয়েছে বলে সাংগঠনিক রিপোর্টে বলা হয়েছে। সেই রিপোর্টের দাবি, দুই দিনাজপুর এবং মালদহের কিছু সংখ্যালঘুপ্রধান আসন ছাড়া কোথাও তৃণমূলের জয়ের পরিস্থিতি নেই। বস্তুত, উত্তর দিনাজপুর ও মালদহে কয়েকটি আসন বিজেপির বদলে কংগ্রেসের ঝুলিতেও যেতে পারে বলে বিজেপি নেতাদের ধারণা। তবে রিপোর্ট বলছে, উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের আসন গতবারের চেয়ে বাড়বে না। বরং কমবে।
২০২১ সালে বাংলার ভোটে সেয়ানে-সেয়ানে টক্করের আবহেও উত্তরবঙ্গে ৩০টির বেশি আসন জিততে পারেনি বিজেপি। সে বারও উত্তরে ‘খান চল্লিশেক’ আসন জেতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিজেপি নেতারা। কিন্তু ফলাফল দাঁড়ায় বিজেপি-৩০, তৃণমূল-২৩, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (তামাং)-১। যদিও বিজেপি উত্তরে নিজেদের সেই সংখ্যাও ধরে রাখতে পারেনি। কারও পদত্যাগ, কারও প্রয়াণে একের পর এক উপনির্বাচন হয়েছে। বিজেপি প্রতিটিতেই হেরেছে। উত্তরবঙ্গে বিধায়কের সংখ্যা ৩০ থেকে নেমে ২৫ হয়েছে। পক্ষান্তরে, তৃণমূল ২৩ থেকে বেড়ে ২৮-এ পৌঁছে গিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য ৩২টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি, ১৫টি বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল এবং সাতটিতে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীরা এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিজেপির সাংগঠনিক রিপোর্টে যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ৩২-এর অনেক বেশি!
আরও পড়ুন:
তবে সেই রিপোর্টের পরেও উত্তরবঙ্গের বিপর্যয়ের পরে বিজেপির স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দ্রুত মাঠে নেমেছিলেন। বিপর্যয়ের পরেই নাগরাকাটায় সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের উপর হামলা হয়। যে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বয়ং। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রিজিজু এবং সাংসদ বিপ্লব দেব খগেন-শঙ্করের সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরও ফোনে কথা বলে খগেনের পরিবারের সঙ্গে। পাশাপাশিই, প্রত্যেক জেলায় নির্দেশ যায় উত্তরবঙ্গের জন্য ত্রাণসংগ্রহ করতে। মঙ্গলবার থেকে বিভিন্ন জেলা কমিটি ত্রাণসামগ্রী বোঝাই ট্রাক পাঠাতে শুরু করে দেয়।
বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের দাবি, দল পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ করেছে, কোনও কৌশলের কথা ভাবেনি। কলকাতার দুর্যোগে অবশ্য বিজেপিকে এমন ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ’ করতে দেখা যায়নি! দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা উত্তরবঙ্গের ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণ যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘কলকাতা রাজধানী। সেখানকার পরিকাঠামোর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতির তুলনাই হয় না। কলকাতার বিপর্যয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তারা তৎপর হন। সেখানকার পুরসভারও অনেক বেশি ক্ষমতা। উত্তরবঙ্গের যে এলাকায় এই বিপর্যয় ঘটেছে, সেখানে প্রশাসনের পৌঁছতে সময় লাগবে। তাই আমরাই শুরু করেছি।’’ রাজনৈতিক লাভক্ষতির প্রশ্নে তিনি বলছেন, ‘‘দুর্যোগের সময়ে কাকে কতটা ছুটতে দেখা গেল, তা দিয়ে গ্রামাঞ্চলে ভোট হয় না। খগেন’দা মার খেলেন বলে আমরা এখানে ভোট বেশি পেয়ে যাব, এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই। তবে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এ সবের একটা প্রভাব পড়ে।’’
উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় এবং খগেনের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বিজেপির ‘তৎপরতা’ শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রভাবিত করলেও উত্তরবঙ্গে কি এর ফল মিলবে না? রাজ্য স্তরের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘উত্তরবঙ্গে আমাদের সে ফলের প্রয়োজনও নেই। ত্রাণে আমাদের ভূমিকা দেখে বোঝা গিয়েছে সেখানে আমাদের সংগঠন কেমন। ভোটটা ঠিক ভাবে করানো গেলেই যথেষ্ট।’’
আরও পড়ুন:
সাংগঠনিক রিপোর্টে যা বলা হয়েছে এবং পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের সংগঠন নিয়ে বিজেপির যা দাবি, তাতে উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের মধ্যে তাদের গোটা পঞ্চাশেক পাওয়া উচিত। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে ‘মেরুকরণ’ বড় বিষয় হয়ে দেখা দেবে। বিজেপি সেই লক্ষ্যেই ভোটের ময়দানে নেমেছে। সাংগঠনিক রিপোর্টেও সংখ্যালঘুপ্রধান আসনগুলিকে ছেড়ে রাখা হয়েছে বলেই বিজেপি সূত্রের খবর। তবে ঘটনাচক্রে, পাঁচ বছর আগের ভোটেও ৪০টি আসন জয়ের বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন দলের নেতারা। বাস্তবে মিলেছিল তার চেয়ে ১০টি কম আসন।
তবে এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন। তৃণমূলের উপরে চেপেছে আরও পাঁচ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভার। পাশাপাশি, খগেন-কাণ্ড এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ‘নেতিবাচক’ প্রভাবও পড়তে পারে শাসকদলের উপর। তবে ভোট পর্যন্ত বিজেপি এই ‘তৎপরতা’ ধরে রাখতে পারে কিনা, সেটাই দেখার।