Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পথ চেনাতে পথেই প্লাবন

মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ....

প্রথম মিছিলে হেঁটেছিলাম, তা সেই এগারো-বারো বছর বয়সে। যুদ্ধবিরোধী মিছিল। বাবার হাত ধরে। আর আজ আবার যেন সেই ‘যুদ্ধবিরোধী’ মিছিলেই পা মেলালাম! ছেলেবেলার সেই মিছিলে ‘পাপেট’ নিয়ে গিয়েছিলাম, কণ্ঠে ছিল, ‘মেরি বাবা মেরি বাবা মেরি বাবা/খাবা খাবা খাবা আমি, খাবা সবই খাবা/থলিতে ভরব যা হাতের কাছে পাবা।’

সুমন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫২
Share: Save:

প্রথম মিছিলে হেঁটেছিলাম, তা সেই এগারো-বারো বছর বয়সে। যুদ্ধবিরোধী মিছিল। বাবার হাত ধরে। আর আজ আবার যেন সেই ‘যুদ্ধবিরোধী’ মিছিলেই পা মেলালাম!

ছেলেবেলার সেই মিছিলে ‘পাপেট’ নিয়ে গিয়েছিলাম, কণ্ঠে ছিল,
মেরি বাবা মেরি বাবা মেরি বাবা
খাবা খাবা খাবা আমি, খাবা সবই খাবা
থলিতে ভরব যা হাতের কাছে পাবা।

তখন আমেরিকার যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে সেই মিছিলে সামিল হয়ে মনে হয়েছিল, ইতিহাসে ঠাঁই করে নিলাম! তখনই ভেবেছিলাম, ‘কমিটমেন্ট’ কথাটা নিছক একটা শব্দ নয়, এটা আদপে ‘অ্যাক্ট’।

ভুল ভেবেছিলাম! ভাবিনি, সেই ‘থলিতে ভরব যা হাতের কাছে পাবা’র বিরুদ্ধে, আর এক ‘যুদ্ধনীতি’র প্রতিবাদে আবার পথে নামব আরও অজস্র ছেলেমেয়ের সঙ্গে, আরও অনেক সহমর্মী মানুষের সঙ্গে!

অবশ্য, এটাই দ্বিতীয় বার মিছিলে হাঁটা নয়। এর আগেও নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরের দিনই, চলচ্চিত্র উৎসবের সময় ছোট মিছিলে হাঁটি। এর পরেই নন্দীগ্রামের ছায়ায় কলেজ স্কোয়ার থেকে সেই মহামিছিল। গিয়েছিলাম ধর্মতলা পর্যন্ত। সেই মৌন মিছিলের শব্দতরঙ্গ বুঝিয়ে দিয়েছিল, পরিবর্তন আসতে চলেছে। তখনও ভাবতে পারিনি, এর মাত্র দু’বছরের মধ্যেই ‘পরিবর্তিত’ এক সরকারের বিরুদ্ধে আবার পথে নামতে হবে।

কামদুনির গণধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে সেই মিছিল থেকে প্রথম পাওয়া গেল মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিরোধী স্বর। তার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে এই রাজ্যে। যা আমাদের ক্রমাগত বিষাদে জর্জরিত করছে। কোনও দিনই তো বুঝিনি যে নির্ভরতার একটা বিশ্বস্ত জায়গা এত দ্রুত ভঙ্গুর হয়ে পড়বে!

মার্কস বলেছিলেন, ইতিহাস পুনরাবর্তিত হয়। প্রথম বার তা হয় ট্র্যাজেডি হিসেবে, দ্বিতীয় বার প্রহসন। আর ইতিহাসবিদ হবসবম এর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তৃতীয় পুনরাবর্তনের মাত্রা: হতাশা। যাদবপুরের ঘটনার পরে অমোঘ সেই তৃতীয় মাত্রার কথাই মনে পড়েছিল। কিন্তু আজকের মিছিলে যখন ছাত্রদের প্রতিবাদী মুখ দেখলাম, প্রতিবাদী স্বর শুনলাম, তখন মনে পড়ে গেল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আর এক অমোঘ পঙক্তি:
মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ,
মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত
আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত...

এই মিছিলের জ্যান্ত, উজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে, এই উদ্যমী, উৎসাহী, নাছোড়বান্দা ছাত্রছাত্রীদের স্লোগানের ছন্দে ছন্দে পা মিলিয়ে যখন হেঁটে চলেছি রবীন্দ্র সদন থেকে রাজভবনের দিকে, তখন বার বার মনে প্রশ্ন উঠেছে, আমি তো শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকেছি! এই মিছিলে আমার কী ভূমিকা? ইতিহাসের স্মৃতি খুঁড়ে বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভেসে উঠছিল ইতিহাসের নানা সময়ের, নানা মুহূর্তের কোলাজ! আচমকাই দৃশ্যমান হল, জাদুঘরের পাশে, পার্ক স্ট্রিট মোড়ে লিফলেট বিলোচ্ছেন জাঁ পল সার্ত্র! পার্ক স্ট্রিটের মোড় যেন আজ ষাটের দশকের ছাত্রবিক্ষোভে বিস্ফারিত প্যারিসের রাজপথ! যেন ঘুম ভেঙেছে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির! সেই লাভাস্রোতে ডুবে যাচ্ছে শাসনতন্ত্রের ইমারত! তারুণ্যের সেই আগুনে নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করতে পেরেছিলেন সার্ত্রের মতো বিশ্ববরেণ্য তাত্ত্বিক। তাঁর সেই অবদান এবং অংশগ্রহণ পৃথিবীর ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। আর এক প্রখ্যাত তাত্ত্বিক আলথুজার অবশ্য সার্ত্রের মতো রাস্তায় নেমে পড়তে পারেননি। ইতিহাস তির্যক ভঙ্গিতে সে কথাও মনে রেখেছে। আসলে, আমাদের সমাজে এক জন চিন্তাবিদ বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’-এর সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা কী, সেটা বোধহয় সার্ত্র এবং আলথুজার-এর এই সক্রিয়তা (অ্যাক্ট) বনাম নির্লিপ্ততার নিরিখে আন্দাজ করা যেতে পারে।

সার্ত্রের মতো লিফলেট বিলোতে হয়তো আমি পারিনি, কিন্তু মিছিলে পা মেলাতে পেরেই তখন মনে হচ্ছিল, আমিও ওদের প্রতিবাদের শরিক হতে পারলাম! আজকে যখন মিছিলে মাথায় ফেট্টি বাঁধা, জামায় স্লোগান আঁকা, হাতে ফেস্টুন ধরা মুখগুলো দেখছিলাম, মনে পড়ে যাচ্ছিল সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা তিয়েনানমেন স্কোয়ারের চিত্রাবলি, বাংলাদেশের শাহবাগের ছবির মন্তাজ! মনে পড়ে যাচ্ছিল, দুনিয়া কাঁপানো সেই ফ্রেম! তিয়েনানমেন স্কোয়ারে আগুয়ান ট্যাঙ্কের সামনে উদ্ধত একক শরীরের ব্যারিকেড!

শুরু হল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিবাদের এক নতুন চিহ্ন, যার ক্যানভাস বিস্তৃত হল তাহরির স্কোয়ার পর্যন্ত। এর অভিঘাতে বদলে গেল শাসকের মুখ, খুলে গেল শাসনযন্ত্রের মুখোশ! শুধু তাই নয়, পুনর্বিন্যস্ত হল রাজনৈতিক প্রতিরোধী এবং শাসকের সম্পর্কের সমীকরণ!

আজকের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে এলোমেলো ভাবে মনে পড়ছিল আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’, জন রিডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’, হেমিংওয়ে-র ‘ফর হুম দ্য বেল টোল্স’ এবং পন্টেকর্ভো-র ‘ব্যাটল অফ আলজিয়ার্স’। এগুলোর সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে সম্পর্ক আছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম। আবার মনে পড়ে যাচ্ছিল, সত্তরের দশকের তুমুল রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝখানে উৎপল দত্তকে যখন কার্যত লুকিয়ে লুকিয়ে করতে হচ্ছে ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ বা বাসে কংগ্রেসিদের বোমা মারার প্রতিবাদে করেছিলেন ‘পেট্রল বোমা’। ভাবছিলাম, উৎপল দত্ত আজ থাকলে কী করতেন?

উৎপলবাবু সম্পর্কে কতগুলি পরস্পরবিরোধী গল্প শোনা যায়। তিনি যেমন সক্রিয় ভাবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে চটজলদি নাটক লিখে ফেলতে পারতেন বা প্রযোজনাও করে ফেলতেন, আবার তেমনই শোনা যায়, মিছিলে হাঁটার জন্য তিনি কুঁজোর মধ্যে পাঞ্জাবি-পাজামা ভরে রাখতেন! বা যখন পুলিশ নাট্যদলের অভিনেতা বা পরিচালককে খুঁজছে, তখন তিনি সহ-অভিনেতাদের এসে বলতেন, ‘কমরেডস, পুলিশ আসছে, পালান!’ এগুলো হয়তো গল্পকথাই! কিন্তু, আমি নিশ্চিত, কমরেড উৎপল দত্ত রাতারাতি ‘নিশিরাতে পুলিশের লাঠি’ নামে কোনও নাটকও করে ফেলতে পারতেন!

আমাদের সময়ের শিল্পীদের অবশ্য এর কোনও ক্ষমতাই নেই। সে কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল। না হলে আজকের মিছিলে অন্তত আরও কিছু মুখ দেখা যেত।

আবার কি আমরা সেই দুঃস্বপ্নের নগরীতে ফিরে যাচ্ছি? আবার কি আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে নাটক করতে হবে? আবারও কি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোনও কথা বললেই কি দেখতে হবে, আমার ভাগ্যে পুলিশের চোখরাঙানি? বা চড়চাপড়ও বটে! বা লাঠির গুঁতো? বা থানায় অনির্দিষ্ট অপেক্ষা? এত সব এলোমেলো আকাশপাতাল ভাবনার মধ্যে চেতনা আবার ফিরিয়ে দিল বাস্তবভূমিতে, কানে ভেসে এল ‘হোক কলরব’ স্লোগান!

দেখলাম, উদ্ধত বুকে, সাহসের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন রাষ্ট্রশক্তির আস্ফালনকে।
ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায়
ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকল
মিছিলের সেই মুখ

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও রণজিৎ নন্দী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE