বন্ধুত্ব, বিচ্ছেদ, প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গ— বিহারের গ্যাংস্টার চন্দন মিশ্রের খুনে এগুলোই হতে পারে মোটিভ। খুনের ঘটনায় আঙুল উঠছে চন্দনেরই একদা কাছের বন্ধু শেরু সিংহ ওরফে ওঙ্কারনাথ সিংহের দিকে। কী ভাবে?
প্রথমে তোলাবাজির বখরা নিয়ে তিক্ততা হয়েছিল চন্দন ও শেরুর। সেখান থেকেই অভিন্নহৃদয় দুই বন্ধুর মধ্যে শত্রুতা শুরু। বিহারের বক্সার জেলার একসময়ের ত্রাস দুই গ্যাংস্টার আলাদা করে দল তৈরি করেন। তাতে গোষ্ঠীকোন্দল থামে। শুরু হয় দুই দলের লড়াই। তা ছাড়াও ছিল প্রেম, সন্দেহ এবং বিশ্বাসভঙ্গের ইস্যু। সে জন্যই সম্প্রতি চন্দনকে খুন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন পুরুলিয়ার জেলে বন্দি থাকা শেরু। মনে করা হচ্ছে, ওই শত্রুতার জেরে গত বৃহস্পতিবার বিহারের পটনার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চন্দনকে গুলি করে খুন করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, পটনার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গ্যাংস্টারকে খুন করে বাংলায় পালিয়ে এসেছিলেন শেরুর কাছে খুনের বরাত পাওয়া দুষ্কৃতীরা। কলকাতা থেকে এ পর্যন্ত ওই দলের ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুরুলিয়া তথা রাজ্য পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, চন্দনের খুন আদতে দুই গ্যাংস্টারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল। তারা আরও জানাচ্ছে, ২০০৮ সালের পর থেকে বিহারের অপরাধজগতে ‘নাম’ করেন চন্দন এবং শেরু। বক্সার জেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল দুই বন্ধুর জগৎ। একের পর এক তোলাবাজি, সুপারি নিয়ে খুন, ডাকাতি, অপহরণ ইত্যাদি নানা অপরাধের সূত্রে বিহারের অন্ধকার জগতে প্রথম সারিতে উঠে এসেছিলেন মানিকজোড়। দু’জনের নানা কীর্তি ছড়িয়ে আছে নীতীশ-লালুর রাজ্যে। কিছু অতিকথন, কিছু সত্যি।
২০১১ সালের ঘটনা। দাবিমতো তোলা না দেওয়ায় সে বছরের ২১ অগস্ট বক্সারের চুন ব্যবসায়ী রাজেন্দ্র কিশোরীকে রাস্তাতেই গুলি করে খুনের অভিযোগ ওঠে চন্দন-শেরুর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় ব্যাপক শোরগোল হয় বিহারে। তখন গা-ঢাকা দিতে নেপালে চলে যান দুই গ্যাংস্টার। বছরখানেক নেপালে কাটিয়ে চুপিচুপি কলকাতায় এসেছিলেন মানিকজোড়। তবে তক্কে তক্কে ছিল বিহার পুলিশ। গোপন সূত্রে ওই খবর পেয়ে বাংলায় আসে তারা। ২০১২ সালে গ্রেফতার হন দুই গ্যাংস্টার। যদিও গারদে পুরেও অপরাধ থেকে দূরে রাখা যায়নি চন্দন ও শেরুকে। অভিযোগ, জেল থেকেই দুষ্কৃতীদলের পরিচালনা করতেন তাঁরা। আবার জেলেই শুরু মন কষাকষির।
পুলিশ সূত্রে খবর, বখরার ভাগ নিয়ে সে বার শেরু ও চন্দনের বিস্তর ঝগড়া হয়। এমনকি, বার দুয়েক জেলের মধ্যে মারপিট করেছেন তাঁরা। তার পর দুই গ্যাংস্টারের পথ দুই দিকে চলে যায়। চন্দন ও শেরু আলাদা আলাদা দল তৈরি করে বিহারের মাটিতে নানা দুষ্কর্ম পরিচালনা করতে থাকেন।
দলে থেকে কাজ করা যাচ্ছিল না, অতএব আলাদা। কিন্তু ঝগড়া থামলেও বিবাদ মিটল না। চন্দন জানতে পারেন, তাঁর তুতো বোনের সঙ্গে প্রেম করছেন শেরু। শুনেই মাথা গরম ‘মিশ্রাজি’র। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘শেরুকে চন্দন বন্ধু ভাবত ঠিকই। কিন্তু, নিম্নবর্ণের একজন তার পরিবারের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করছে, এটা চন্দনের মতো গোঁড়া লোকের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। ফলাফল, শত্রুতা।’’ তার সঙ্গে যুক্ত হয় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা।
একটি গয়নার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় ধৃত শেরু এখন পুরুলিয়ার জেলে। কিন্তু চন্দনের খোঁজ তাঁর কাছে ঠিকই থাকে। যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া চন্দন কী ভাবে সমাজমাধ্যমে সক্রিয় থাকেন, এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে শেরুর মনে। বস্তুত, চন্দনের নামে ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মাঝেমধ্যেই নানা রিল্স পোস্ট হয়। শেরু মনে করতে শুরু করেন, তার দল সম্পর্কে বিহার পুলিশকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে জেলে বসেও নানা সুযোগ ভোগ করছেন প্রাক্তন বন্ধু।
বস্তুত, শারীরিক কারণ দেখিয়ে ১৫ দিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন চন্দন। অন্য দিকে, শেরুও প্যারোলের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তা খারিজ হয়ে গিয়েছে। এই সমস্ত ঘটনার যোগফল চন্দনের প্রতি শেরুর রাগ তীব্র করেছে।
বক্সারে দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য এখন অনেকাংশে আয়ত্তে এনেছে বিহার সরকার। কিন্তু সেখানেও শেরু ও চন্দনের দ্বন্দ্ব। শেরুর বাহিনী মনে করে চন্দনদের সঙ্গীদের পাকড়াও করে জেলে ভরা হলেও তাদের লোকেদের এনকাউন্টারে শেষ করে দিচ্ছে পুলিশ। বস্তুত, শেরুর ঘোর সন্দেহ যে, চন্দন পুলিশের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়ে তাঁর দলকে কোণঠাসা করছে।
তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই একের পর এক ঘটনায় শেরুর মনে চন্দনের প্রতি তীব্র রাগ এবং ঈর্ষার সৃষ্টি করে। তাই পুরুলিয়া জেলা সংশোধনাগারে বসেই পটনার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চন্দনকে খুনের নিখুঁত ছক কষেন তিনি। অপারেশনের জন্য মোটা অঙ্কের সুপারি দেওয়া হয় তৌসিফ রাজা ওরফে বাদশার দলকে। বাকিটা তদন্তসাপেক্ষ।