Advertisement
E-Paper

খয়রাতির রাজ্যে বেতন বাড়ন্ত, কমিশন তো হবে, কিন্তু টাকা কোথায়

শুধু ঋণে রক্ষা নেই, বেতন-বোঝা দোসর! বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ ঘোষিত হওয়ার পরে শুক্রবার নবান্নের কর্মচারী মহলে আলোচনার একমাত্র বিষয়ই ছিল, রাজ্যের বেতন কমিশন কবে? দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে আধিকারিক স্তরেও। নবান্ন সূত্রের খবর, দু’এক দিনের মধ্যেই রাজ্যের ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৩

শুধু ঋণে রক্ষা নেই, বেতন-বোঝা দোসর!

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ ঘোষিত হওয়ার পরে শুক্রবার নবান্নের কর্মচারী মহলে আলোচনার একমাত্র বিষয়ই ছিল, রাজ্যের বেতন কমিশন কবে? দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে আধিকারিক স্তরেও। নবান্ন সূত্রের খবর, দু’এক দিনের মধ্যেই রাজ্যের ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবে।

কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ঘাড়ে চেপে বসা ঋণের ফাঁসে রাজ্যের এখন হাঁসফাঁস দশা। বাম আমল থেকে শুরু হওয়া ধারের কলেবর তৃণমূলের জমানায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বছর দুয়েক পর থেকে সেই ঋণের একটা বড় অংশের আসল মেটাতে হবে। গত কয়েক বছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়লেও মেলা-খেলা-উৎসব খাতে খরচাও বেড়েছে দেদার। ফলে সুদ-আসল মেটানোর চাপ যখন বাড়বে, তখন সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানো হবে কী ভাবে, তাই ভেবে রাতের ঘুম ছুটেছে নবান্নের কর্তাদের। তার উপর বেতন কমিশনের সুপারিশের বোঝা এলে পরিস্থিতি কী ভাবে সামলানো হবে, সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা। অর্থ দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘সব মিলিয়ে অবস্থা যা দাঁড়াবে, তাতে প্রাণ বাঁচাতে নবান্ন ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় দেখছি না!’’

কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশে মূল বেতনের ১৪.২৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য ভাতা এবং পেনশনও বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। আগামী বছরের প্রথম দিন থেকে এই সুপারিশ কার্যকর হবে। তার জেরে বছরে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বাড়তি খরচের বোঝা চাপবে কেন্দ্রে ঘাড়ে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়ায় বলেছিলেন, কেন্দ্র বর্ধিত বেতনের দায়িত্ব না-নিলে তিনি রাজ্যের জন্য বেতন কমিশন গঠন করবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মত পাল্টে কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই তাঁর এই মত বদল বলে অনেকের ধারণা। বেতন কমিশন গঠনের পরে তারা সুপারিশ যবেই পেশ করুক এবং সরকার তা যবেই গ্রহণ করুক, আগামী অর্থ বছরের গোড়া থেকেই তা কার্যকর করতে (এফেক্ট দিতে) হবে। সুপারিশ পরে কার্যকর হলে মধ্যবর্তী সময়ের টাকা বকেয়া (এরিয়ার) হিসেবে শোধ করতে হবে।

কতটা বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করতে পারে রাজ্যের কমিশন?

রাজ্যে পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে (২০০৯ সালে) কর্মীদের বেতন ও পেনশন বৃদ্ধি হয়েছিল গড়পড়তা ৬০%। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার ফারাক এখন ৫৪ শতাংশ। ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে বেতনবৃদ্ধির সমতা রাখতে গেলে প্রায় ৮০ শতাংশ বেতন বাড়াতে হবে রাজ্যকে। কিন্তু তেমনটা প্রায় অসম্ভব বলেই মেনে নিচ্ছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। তাঁরা ৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি ধরে নিয়েই অঙ্ক কষা শুরু করেছেন। বেতন কাঠামো সংস্কারের পরের বছর থেকে বেতন খাতে ১০ শতাংশ এবং পেনশন খাতে ১২ শতাংশ খরচ বাড়বে অনুমান করে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের মাধ্যমে দিল্লিকে জানিয়ে দিয়েছে রাজ্য।

অর্থ দফতরের এক কর্তা জানান, এখনই বেতন-পেনশন দিতে খরচ হচ্ছে বছরে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। পরের বছর থেকে নতুন হারে বেতনবৃদ্ধি কার্যকর করতে হলে ২০১৯-’২০ সালে গিয়ে সরকারের অতিরিক্ত খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৮৩ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। ওই চার বছরে ঋণের সুদ ও আসল মেটাতে খরচ হবে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা। ‘‘এত টাকা আসবে কোত্থেকে?’’ প্রশ্ন ওই আধিকারিকের।

এক কথায় এর জবাব নেই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছেও। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বাম জমানার পাপের ফল আমাদের ভুগতে হচ্ছে। কেন্দ্রকে অন্তত দশ বার বলা সত্ত্বেও তারা কোনও সাহায্য করছে না। মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, নিলামে তুললেও এই সরকারকে কেউ নেবে না। তবুও তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। এ ভাবেই কোনও উপায় বেরোবে।’’

ঋণের সুদ ও আসল মেটানোর উপর যেমন ‘মোরাটোরিয়াম’ চেয়েছে মমতার সরকার, তেমনই বর্ধিত বেতনের দায়ও দিল্লির ঘাড়ে চাপাতে চেয়ে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের কাছে টাকা চেয়েছিল নবান্ন। চার বছরের জন্য সব মিলিয়ে অতিরিক্ত প্রায় ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। রাজ্য সরকারের যুক্তি ছিল, কেন্দ্র সপ্তম বেতন কমিশন গঠন করেছে বলেই চাপে পড়ে রাজ্যকে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করতে হয়েছে। তাই বর্ধিত বেতন-কমিশনের যাবতীয় আর্থিক দায় কেন্দ্রকেই বহন করতে হবে। কমিশন অবশ্য রাজ্যের ওই দাবিতে কর্ণপাত করেনি।

সূত্রের খবর, রাজ্যের এই দাবি নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের মতামত চেয়েছিল অর্থ কমিশন। মন্ত্রক জানিয়ে দেয়, কোনও রাজ্যকেই সরকারি কর্মীদের বেতন দেয় না কেন্দ্র। তা হলে এখন সেই প্রশ্ন উঠছে কেন! অর্থ মন্ত্রকের দাওয়াই ছিল, রাজ্য সরকারকেই নিজেদের রাজস্ব বাড়িয়ে এবং খরচের লাগাম টেনে বেতন বৃদ্ধির চাপ সামলাতে হবে।

পরিস্থিতি যে সত্যিই দিশেহারা হওয়ার মতো তা মানছেন নবান্নের কর্তারা। কারণ, পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ মানতে গিয়ে ২০০৯-’১০ সালে বেতন খাতে রাজ্যের খরচ বেড়েছিল প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সেই ধাক্কা সামলাতেই বাজার থেকে দেদার ঋণ নেওয়া শুরু করেছিল বাম সরকার। তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা ছিল ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি। সেটাই বাড়তে বাড়তে চলতি অর্থবর্ষের শেষে দাঁড়াবে তিন লক্ষ কোটিতে। এই বেপরোয়া মেয়াদি ঋণের আসল শোধের সময় শুরু হবে ২০১৭-’১৮ সাল থেকে। ফলে ওই সময় এক দিকে ঋণ শোধে যেমন কোষাগার উজাড় হবে, তেমনই নতুন বেতন কমিশনের জেরে বাড়তি দায় চাপবে রাজ্যের ঘাড়ে।

ঋণ শোধের বোঝা ঘাড়ে নিয়েও কেন নতুন বেতন কমিশনের ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী?

কেন্দ্র টাকা না দিলে বেতন কমিশন হবে না, এই ঘোষণা থেকে সরে এলেন কেন?

অনেকেই এর পিছনে ভোটের অঙ্ক দেখছেন। বাম আমলে শেষবার বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০০৬ সালে, যার সুপারিশ কার্যকর হয় ২০০৯-এ। অর্থ দফতরের এক কর্তা জানান, আগের সরকার তখন বকেয়ার পুরোটা সঙ্গে সঙ্গে মেটাতে পারেনি। এ বার বিধানসভা ভোট ২০১৬-র এপ্রিল-মে মাসে হওয়ার কথা। তার আগে বেতন কমিশন গঠন করে সরকার কর্মচারীদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘বিধানসভার ভোটের আগে বেতন কমিশন গঠনের ঘোষণা আর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে তা কার্যকর করা— সময় হিসাবে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত।’’

westbengal sixth pay commisssion jagannath chattopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy