বছর তিনেক আগেও ক্লাসঘরে জ্বলত আলো-পাখা। স্কুলবাড়ি গমগম করত পড়ুয়াদের গানে-গল্পে। কয়েকশো পড়ুয়ার জন্য থাকত মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে মাসে ৫০ টাকা করে সরকারি অনুদান। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্কুলবাড়ি এখন কার্যত খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে। আগাছা জন্মেছে স্কুলবাড়ির চারদিকে।
কোভিড-পর্বের পরে, বছর তিনেক আগেই তালা পড়েছিল হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড়ে তৈরি হওয়া শিশু শ্রমিকদের ওই স্কুলে। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শ্রমিক শিশু কল্যাণ প্রকল্পের আওতায় হাওড়া জেলার আরও ১৭টি স্কুলের মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ভাগাড়ে বসবাসকারী ১৩০টি হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন। স্কুলের দরজা সেই যে বন্ধ হয়েছিল, তার পরে আর খোলেনি। তবে এত দিন পরে ভাগাড়ের বস্তিতে থাকা শিশুদের জন্য ফের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আকাশের নীচেই ওইসব শিশুদের জন্য বসছে ক্লাস।
কয়েক মাস আগে গোটা ভাগাড় জুড়ে ভয়াবহ ধস নামায় বেঘর হয়েছিল ৭০টির বেশি পরিবার। ভেঙে পড়েছিল বস্তির অধিকাংশ ঘর। রাস্তা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ হয় বিদ্যুৎ, পানীয় জল পরিষেবাও। মাথার উপর থেকে ছাদ চলে যাওয়ায় অনেককেই আশ্রয় নিতে হয়েছিল সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। তিন বছর আগে ওই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাগাড়ের শিশু শিক্ষার্থীরা হারিয়েছিল শিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ। আর ধসের জেরে ভাগাড়ের আবর্জনা থেকে সংগ্রহ করা প্লাস্টিক-সহ অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে কোনও রকমে বেঁচে থাকা পরিবারগুলি হারিয়েছিল বাসস্থান ও অন্নসংস্থানের সুযোগ। যদিও ভয়াবহ সেই ধসের পরে রাজ্য প্রশাসনের তরফে সবক’টি পরিবারের যথার্থ পুনর্বাসনের আশ্বাস মিলেছিল। কিন্তু অভিযোগ, ঘটনার পরে চার মাস কেটে গেলেও তা যেমন জোটেনি, তেমনই এত দিন পরেও ধসের জেরে যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার চিহ্ন মোছা যায়নি।
তবু এর মধ্যেই ভাগাড়ের বস্তিতে থাকা শিশুদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে শুরু হয়েছে পড়ানো। তবে তা শুরু হয়েছে শান্তিনিকেতনের কায়দায় খোলা আকাশের নীচে, বটের ছায়ায়। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে দশরথ শর্মা বলেন, ‘‘প্রচন্ড রোদে পড়াশোনা চালানো যাচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে বৃষ্টি হলেও। তাই মাঝেমধ্যে পড়ানো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বন্ধ স্কুলবাড়িটা প্রশাসন দিলে আমরা ওর ভিতরে ক্লাস করতে পারি।’’ ইতিমধ্যেই ক্লাসে আসছে স্থানীয় ১৩০ জন পড়ুয়া। তাদের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। ক্লাস হচ্ছে নার্সারি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। এলাকারই ৪-৫ জন বাসিন্দা মিলে বিনা বেতনে পড়াচ্ছেন খুদেদের। এক শিক্ষিকা রানি হেলার কথায়, ‘‘সমস্যা হল, বৃষ্টি এলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটি দিয়ে দিতে হচ্ছে। আর প্রবল গরমের সময়েও ক্লাস বন্ধ থাকছে।’’ গরম এড়াতে এ বার বিকেল থেকে সেখানে চলছে ক্লাস।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিশু শ্রমিক কল্যাণের আওতায় হাওড়া জেলা ‘চাইল্ড লেবার রিহ্যাবিলিটেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র এই ধরনের স্কুল গোটা জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। সব মিলিয়ে স্কুলগুলিতে ১৫০ জনেরও বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন। কেন্দ্রের পাঠানো টাকায় স্কুলগুলিতে মিড-ডে মিল-সহ পড়ুয়াদের প্রতি মাসে আর্থিক সাহায্যও করা হত। কিন্তু ২০২২ সালের করোনার পরে সব বন্ধ হয়ে যায়। তালা পড়ে যায় সব স্কুলে। কাজ হারান সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।
এ বিষয়ে হাওড়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পের টাকা মাঝেমধ্যেইআসত না। করোনার সময়ে লকডাউনের পরে স্কুলগুলি আর খোলেনি। পরে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পটি সমগ্র শিক্ষা মিশন প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত করলেও বন্ধ স্কুল চালু করার ব্যাপারে কোনও নির্দেশ দেয়নি। বন্ধ থাকা স্কুলগুলি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি রাজ্যও।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)