Advertisement
E-Paper

আতঙ্কের নাম গঙ্গা, ভাঙন রুখতে বোল্ডারের দাবি গ্রামবাসীর

এক মাস অতিক্রান্ত। হুগলির বলাগড় ব্লকের জিরাট পঞ্চায়েতের প্রান্তিক জনপদ খয়রামারির আতঙ্ক এখনও কাটেনি। কারণ, নদী-ভাঙন বন্ধ হয়নি। দীঘদিন ধরে আগ্রাসী গঙ্গা এ তল্লাটের বিঘের পর বিঘে কৃষিজমি, বাড়িঘর, দোকানপাট, খেলার মাঠ, বাজার গিলে নিয়েছে।

প্রকাশ পাল

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:৩২
জলমগ্ন: কিছু দিন আগেও খেজুর গাছটি ছিল ডাঙায়।

জলমগ্ন: কিছু দিন আগেও খেজুর গাছটি ছিল ডাঙায়।

দশমীর রাত। সর্বত্র চলছে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়। খয়রামারি রাত জাগছে। আনন্দে নয়, আতঙ্কে। আবার সেই ‘ধুপ-ধাপ’ শব্দটা ফিরে এসেছে। পাড় ভাঙছে গঙ্গা।

এক মাস অতিক্রান্ত। হুগলির বলাগড় ব্লকের জিরাট পঞ্চায়েতের প্রান্তিক জনপদ খয়রামারির আতঙ্ক এখনও কাটেনি। কারণ, নদী-ভাঙন বন্ধ হয়নি। দীঘদিন ধরে আগ্রাসী গঙ্গা এ তল্লাটের বিঘের পর বিঘে কৃষিজমি, বাড়িঘর, দোকানপাট, খেলার মাঠ, বাজার গিলে নিয়েছে। ফের শুরু হয়েছে হানাদারি।

দশমীর সন্ধ্যা পর্যন্ত রানিনগর খেয়াঘাটের পাশেই টিকে ছিল উত্তম সরকারের চায়ের দোকান। এখন আর অস্তিত্ব নেই। শুধু পাশের খেজুর গাছটা জলের উপর জেগে রয়েছে। দিন কয়েক আগে নতুন দোকান করেছেন উত্তম। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের কয়েক একর জমি গঙ্গায় চলে গিয়েছে। দু’বার বাড়ি গিয়েছে। এই নিয়ে দোকান সরাতে দোকা‌ন সরাতে হল অন্তত দশ বার।’’ স্ত্রী দীপিকা জুড়ে দেন, ‘‘গঙ্গার জন্য আমাদের ভাঙাগড়ার সংসার। গঙ্গা যতবার ভাঙে, আমরা গড়ি। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন!’’

কী ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন?

গ্রামবাসীরা জানান, ভাঙন রোধে ব্যবস্থার দাবিতে স্থানীয় প্রশাসন থেকে দিল্লি পর্যন্ত দরবার করা হয়েছে। এক বার গঙ্গায় বাঁশের খাঁচা ফেলা হয়েছিল। দু’বছর আগে ভেটিভার ঘাস চাষ করা হয়েছিল। তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। বৃদ্ধ অরবিন্দ ঘোষালের খেদ, ‘‘যা কাজ হয়েছে, তাতে পুকুর ভাঙন আটকায়, সর্বগ্রাসী গঙ্গা ‌নয়। ঘাসের শিকড় পুরোপুরি মাটিতে ঢোকার আগেই সবশুদ্ধ ভেঙে চলে গেল। অত গভীর হয়ে ভাঙলে এতে আটকায়!’’ গ্রামবাসীর দাবি, একমাত্র কংক্রিটের বোল্ডার ফেলা হলেই ভাঙন আটকানো সম্ভব।

অবশ্য শুধু খয়রামারি নয়, এই ব্লকের চাদরাও প্রবল ভাবে ভাঙনের মুখে। এখানেও উদ্বেগে রয়েছেন গ্রামবাসী। মিলনগড়, সূর্যপুর, বাণেশ্বরপুরেও গঙ্গার চোখরাঙান‌ি চলছে। গ্রামবাসীরা মনে করছে‌ন, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের সমন্বয়ে নির্দিষ্ট প্রকল্প না হলে গঙ্গাকে রোখা মুশকিল‌।

স্থানীয় বিধায়ক অসীম মাঝি জানান, ব্যবস্থা নেওয়া হলেও চাদরা, খয়রামারির গভীর ভাঙনে তা কাজে আসেনি। কেন্দ্রীয় প্রকল্প ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘‘সেচ দফতরের বৈঠকে এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। সেচ দফতরের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’’ বিডিও (বলাগড়) সমিত সমিত সরকার বলেন, ‘‘গত এক বছরে ব্লকে ৩৫টি বাড়ি ভাঙনের ফলে তলিয়ে গিয়েছে। কোনও জায়গায় ৮০ ফুট, কোথাও ১০০ ফুট এগিয়েছে গঙ্গা। জেলায় বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।’’

বছর দশেক আগেও খয়রামারিতে প্রায় পাঁচশো পরিবারের বাস ছিল। এখন তিনশো। ভোটার সংখ্যা হাজারখানেক। গঙ্গা ভাঙনের জেরে অনেকে বেঘর হয়ে কেউ জিরাটে রেললাইনের ধারে, কেউ বর্ধমানের কালনা, কেউ বা নদিয়ার চাকদহ, শিমুরালিতে ঘর বেঁধেছেন। খেত হারিয়ে চাষি থেকে কেউ বনে গিয়েছেন খেতমজুর। কেউ করছেন অন্য ছোটখাটো কাজ।

গ্রামবাসীরা জানান, গৌরনগর মৌজা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। রানিনগর মৌজার সিংহভাগ গিয়েছে। দুর্লভপুর মৌজার কিছুটা টিকে আছে। এখনই ব্যবস্থা না-নিলে অদূর অবিষ্যতে মানচিত্র থেকে গ্রামের অস্তিত্বই পুরো মুছে যাবে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় গঙ্গা থেকে আর মাত্র কয়েক মিটার দূরে। বর্ষায় এলাকা জলমগ্ন হলে এই স্কুলভবনই হয়ে ওঠে ‘ফ্লাড শেল্টার’। যুবক অসীম ঘোষালের দুশ্চিন্তা, ‘‘স্কুলখানা চলে গেলে বাচ্চারা কোথায় পড়বে? বন্যায় ঠাঁই নেওয়ারও আর জায়গা থাকবে না।’’

বাঁশের মাচায় বসে ফ্যালফ্যাল করে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে অরবিন্দবাবু আগ্রাসী নদীকে গাল পাড়েন। বলতে থাকেন, ‘‘আমরা বেঁচেবর্তে থাকি, গঙ্গা তা চায় না। আর কত ভাঙবে? আর কত কী গ্রাস করবে?’’

Erosion River Ganges Jirat Balagarh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy