চলছে গণেশের গায়ে রং চড়ানোর প্রস্তুতি। ছবি: সুব্রত জানা।
প্যান্ডেলে চলছে ‘ফিনিশং টাচ’। শিল্পীর ঘর থেকে দুগ্গার মণ্ডপে যাওয়ার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। অথচ চোখে ঘুম নেই শঙ্কর ধাড়া, রঞ্জিত পাত্রর।
উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুর কালীতলায় প্রচণ্ড ব্যস্ত তাঁদের মতো অনেকে। কারণ এখনও যে আসল কাজই বাকি। রঙের প্রলেপই পড়েনি প্রতিমার গায়ে।
ঠাকুর তৈরিতে উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুর কালীতলার খ্যাতি বহুদিনের। শিল্পী কালীপদ ধাড়া, পঞ্চানন পাত্রদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল পথচলা। কালীপদবাবু পঞ্চাননবাবুরা বেঁচে নেই। তবে তাঁদের বংশধররা আছেন। শঙ্করবাবু, রঞ্জিৎবাবুদের হাত ধরে এখন ডালপালা ছড়িয়েছে এখানকার মৃৎশিল্পের। ক্রমশ এখানে ভিড় জমিয়েছেন অন্য শিল্পীরা। রাস্তার ধারে একের পর এক গড়ে উঠেছে স্টুডিও। ছড়িয়েছে নাম। অন্তত ১০০ শিল্পীর রুটি রুজির জোগাড় হচ্ছে এখান থেকে। শুধু দুর্গা নয়, সারা বছর ধরেই চলে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রতিমা-সহ অন্য ঠাকুর তৈরি। কার্যত কাজের অভাব না থাকলেও, কাজ করে কিন্তু লাভের কড়ি ঘরে তুলতচে পারেন না শিল্পীরা।
কেন এমন অবস্থা?
শিল্পীরাই জানালেন, মূল সমস্যা পুঁজির। ঠাকুর তৈরির সমস্ত জিনিসের দাম বাড়ে প্রতি বছর, কিন্তু তাঁরা ঠাকুরের দাম বাড়ালেই ওঠে নানা প্রশ্ন। দাম কমানোর জন্য পীড়াপিড়ি করতে থাকেন ক্রেতারা। পাছে বিক্রি না হয়, এই আশঙ্কায় অল্প দামেই ছেড়ে দিতে হয় প্রতিমা। লাভের কড়ি তো দূরঅস্ত, অনেক সময় খরচ তোলাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো রয়েছে পুঁজির সমস্যা।
রঞ্জিৎবাবুর কথায়, ‘‘প্রতি বছরই পুজোর আগে মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হয়। মরসুম শেষে সুদ সমেত ধার মেটাতে হয়। এর পর যে টাকা হাতে থাকে তাতে পুজোর আনন্দ তো দূর, সংসার চালানোই দুষ্কর হয়ে ওঠে।’’ শিল্পীদের দাবি, পুঁজির সমস্যা মিটলে তাঁদের হাতে বাড়তি কিছু পয়সা থাকত। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কঋণ যে তাঁদের প্রথম পছন্দ তাও জানান তাঁরা। অথচ সেই ব্যাঙ্কঋণই তাঁরা পান না বলে অভিযোগ শিল্পীদের। তাঁদের বক্তব্য, ঋণের আবেদন নিয়ে ব্যাঙ্কে গেলেও তা বিবেচনা করা হয় না। ব্যাঙ্ক থেকে চাওয়া হয় জমি বা বাড়ির দলিল। কিন্তু তাঁদের বেশিরভাগেরই সে সব কিছুই নেই। ফলে খালি হাতেই ফিরতে হয়।
কাশীনাথ পাত্র নামে এক শিল্পী বলেন, ‘‘পারিবারিক কারণে কিছু ঋণ হয়ে গিয়েছিল। ফলে মহাজনেরা নতুন করে আর ধার দিতে রাজি হননি। কাগজপত্র নিয়ে ব্যাঙ্কে গেলাম। তারা সাফ জানিয়ে দিল, এই শিল্পে ঋণ দেওয়া যাবে না। টাকার অভাবে এ বছর মাত্র চারটি প্রতিমা করতে পেরেছি। অথচ অন্যবার গড়ে ১০টি করে প্রতিমা তৈরি করেছি।’’
প্রতিমাশিল্পীদের এমন অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছিল বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কাছে। হাওড়া জেলা লিড ব্যাঙ্কের তরফে জানানো হয়েছে, প্রতিমা শিল্পীদের জন্য আলাদা করে ঋণ দেওয়ার আইনি সংস্থান নেই। তবে প্রতিমা তৈরিতে যুক্ত শিল্পীরা যদি মৃৎশিল্পী হিসাবে শংসাপত্র আনতে পারেন তা হলে তাঁদের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। মৃৎশিল্পীদের শংসাপত্র দেয় তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর। ওই দফতর সূত্রে খবর, তাঁদের কাছে শংসাপত্র চেয়ে কেউ আবেদন করেননি।
তবে এ সবের মধ্যে পড়েও প্রতিমা তৈরি বন্ধ হয়নি বীরশিবপুর কালীতলার শিল্পীদের। পঞ্চমীর মধ্যেই কাজ তুলে দিতে হবে। তাই নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন রণজিৎবাবুরা। তাঁর কথায়, ‘‘তিন মাস ধরে এখানে কর্মযজ্ঞ চলছে। দুর্গার পরেই শুরু হয়ে যাবে লক্ষ্মীপুজো। তারপর কালীপুজো। তবু দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্যই আলাদা। পঞ্চমীর পরে ফাঁকা স্টুডিও দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। শুরু হয় পরের বছরের জন্য অপেক্ষা।’’
প্রতিমার গায়ে খড়িমাটি স্প্রে করার ফাঁকে তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে আসে হতাশার দীর্ঘশ্বাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy