নিমন্ত্রিতরা হাজির। বিয়ের পিঁড়িতে কনে। মন্ত্রোচ্চারণ করছেন পুরোহিত। হঠাৎই সেখানে হাজির পুলিশ-প্রশাসনের লোকজন। নির্দেশ দিলেন বিয়ে বন্ধের। কারণ কনে নাবালিকা। কিন্তু নারাজ কনে-পাত্রের বাড়ির লোকজন। অনেক বোঝানোর পর শেষমেশ বিয়ে বন্ধে রাজি হলেন তাঁরা। গত সোমবার হুগলির শ্রীরামপুরের চাঁপসড়া গোলদারপাড়ায় আরও এক নাবালিকার বিয়ে বন্ধ হল প্রশাসনের তৎপরতায়।
যদিও সরকারি দফতর, প্রচার ও প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও কেন জেলায় নাবালিকা বিয়ের প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রায় প্রতিদিনই চাইল্ড লাইনের কাছে কোনও না কোনও নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার খবর আসছে। মুখ্যমন্ত্রী কন্যাশ্রী প্রকল্পের পরে প্রশাসন ভেবেছিল, এর দ্বারা সচেতনতা বাড়বে। দাঁড়ি পড়বে নাবালিকা বিয়ের প্রবণতায়। কিন্তু আদতে তা যে হচ্ছে না, শ্রীরামপুরের চাঁপসড়ার ঘটনায় ফের তা প্রমাণ হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, গত বছর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অন্তত ৬০ জন নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা গিয়েছিল। নতুন বছরে এর মধ্যেই সংখ্যাটা অন্তত ১০। শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া ব্লকের কানাইপুর, চণ্ডীতলা, ভদ্রেশ্বর, মগরা, পাণ্ডুয়া, তারকেশ্বর-সহ বিভিন্ন এলাকায় নাবালিকার বিয়ের খবর পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি কানাইপুরে প্রশাসনের তরফে দু’টি মেয়ের বিয়ে আটকানো হয়। আঠারো বছর না হলে মেয়ের বিয়ে দেওয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দেন বাড়ির লোকেরা। কয়েক দিনের মধ্যেই অবশ্য লুকিয়ে-চুরিয়ে দু’জনেরই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েদু’টিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
প্রসঙ্গ নাবালিকা-বিয়ে
“পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এখনও মেয়েকে বহু পরিবারে বোঝা মনে করা হয়। মেয়েদের এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যেন সংসার সামলানোই তার প্রধান কাজ। এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল না হলে সরকারি প্রচারেও কাজের কাজ হবে না।” —মধুসূদন নন্দন, সমাজতত্ত্ববিদ
কেন এই পরিস্থিতি?
চাইল্ড লাইনের কর্মীদের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ক্ষেত্রে আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো অনেকটা দায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ে আটকাতে গিয়ে দেখা যায়, মেয়ের বাড়ির অবস্থা সচ্ছল নয়। কারও বাবার চায়ের দোকান, কারও বাবা দিনমজুরি করেন। পরিসংখ্যান বলছে, কোন্নগর পুরসভা ঘেঁষা কানাইপুর পঞ্চায়েতে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। চাইল্ড লাইন বা পুলিশ জানাচ্ছে, নাবালিকার বিয়ে আটকাতে গিয়ে অনেক জায়গাতেই তাঁদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, মেয়েকে বড় করার পরে কেন তার বিয়ের ব্যাপারে প্রশাসন নাক গলাবে? বিয়ে না দিলে তার ভরণপোষণের খরচ কে দেবেন, শুনতে হয় এমন প্রশ্নও। অনেক বাবা-মাই জানান, সাংসারিক অভাবের কারণে মেয়েকে ‘পার করা’ তাঁদের কাছে মস্ত দুশ্চিন্তা। তাই পাত্র পেলে আর হাতছাড়া করতে চান না তাঁরা।
চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর গোপীবল্লভ শ্যামল বলেন, ‘‘কোনও নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করলেও নিয়মিত খোঁজ রাখতে হয়, পাছে ফের বাড়ির লোকেরা একই কাজ করেন!’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘স্কুলে প্রচারের পাশাপাশি ডেকরেটর, নাপিত, পুরুত, কেটারিং-সহ বিয়ের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিকেও নাবালিকা বিয়ে বন্ধে প্রচারে নামানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে যার সুফলও মিলেছে।’’ এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টা ১০৯৮ নম্বরে ফোন করে যে কেউ ঘটনার কথা জানাতে পারেন বলেও তিনি জানান। বিভিন্ন জেলায় যে ভাবে স্কুলের স্কুলছাত্রীদের মধ্যে নাবালিকা বিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা দিচ্ছে তা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সমাজতত্ত্ববিদ মধুসূদন নন্দনের মতে, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এখনও মেয়েকে বহু পরিবারে বোঝা হিসেবে মনে করা হয়। মেয়েদের এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যেন সংসার সামলানোই তার প্রধান কাজ। এই মানসিক কাঠামো এবং দৃষ্টিভঙ্গির বদল না হলে সরকারি প্রচারেও কাজের কাজ হবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy