Advertisement
E-Paper

বাম আমলের কর ‘কারচুপি’ ধরল পুরসভা

ট্রেড লাইসেন্স ফি বাবদ আয় হওয়ার কথা প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু সারা বছরে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকার বেশি আয় হতো না পুরসভার। অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের একাংশকে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাইয়ে দিতে দীর্ঘ দিন ধরে এ ভাবেই ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার রেওয়াজ চলছিল সিপিএম পরিচালিত সাবেক বালি পুরসভায়।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৬ ০১:২১

ট্রেড লাইসেন্স ফি বাবদ আয় হওয়ার কথা প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু সারা বছরে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকার বেশি আয় হতো না পুরসভার। অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের একাংশকে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাইয়ে দিতে দীর্ঘ দিন ধরে এ ভাবেই ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার রেওয়াজ চলছিল সিপিএম পরিচালিত সাবেক বালি পুরসভায়। গোটা আর্থিক বছরে সংগৃহীত রাজস্বের প্রায় কয়েক গুণ বেশি টাকা মাত্র তিন মাসেই আদায় হওয়া সেটাই প্রমাণ করছে বলে দাবি বর্তমান পুরকর্তাদের। হাওড়া পুরসভার রাজস্ব দফতরের দেওয়া পরিসংখ্যান সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসেছিলেন কর্তৃপক্ষ। পুরসভার তরফে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নোটিস, এসএমএস ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছতেই গত তিন মাসে কর দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়।

২০১৫-র জুলাই মাসে বালির দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ‘বিশেষ সুবিধা’র জেরে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার এই বিষয়টি নজরে আসে হাওড়ার পুরকর্তাদের। তদন্তে তাঁরা দেখেন, বালি পুর-এলাকায় শতকরা হিসেবে ১০০-র মধ্যে মাত্র ১৫-২০ জন তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব জমা দেন। আর বাকিরা দিনের পর দিন ট্রেড লাইসেন্স পুর্ননবীকরণ না করেও রীতিমতো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও আবার কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা চললেও কয়েক হাজার টাকার যৎসামান্য কর দিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা।

পুরসভা সূত্রের খবর, ২০১৪-২০১৫ আর্থিক বছরে বালি, বেলুড়, লিলুয়া অঞ্চলে ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স বাবদ আদায় হয়েছিল মাত্র ৪৪ লক্ষ টাকা। সেখানে ২০১৫-র জুলাই মাসে বালির দায়িত্ব নেওয়ার পরে মাত্র ন’মাসে অর্থাৎ ২০১৬ এর মার্চ পর্যন্ত বালি পুর-এলাকা থেকে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব আদায় হয় প্রায় ৭৯ লক্ষ টাকা। হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ (রাজস্ব) অরুণ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘মাত্র ন’মাসে যদি ৩৫ লক্ষ টাকা আয় বাড়ানো যায়, তা হলে বোঝাই যাচ্ছে সিপিএম পরিচালিত বালি পুরসভার কর্তারা এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চক্করে রাজ্য সরকারের কত ক্ষতি করেছেন!’’

মেয়র রথীন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এক শ্রেণির ব্যবসায়ীকে বিশেষ সুবি‌ধা পাইয়ে দিতে সরকারের রাজস্বে ফাঁকি দিয়েছেন সাবেক বালি পুর-বোর্ডের কর্তারা। ফলে বালির মানুষ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতেই বালির উন্নয়নে কাজ করার জন্য রাজস্ব আদায়ে জোর দিয়েছি।’’ যদিও এই অভিযোগ মানতে রাজি নন সাবেক বালি পুরসভার চেয়ারম্যান, সিপিএমের অরুণাভ লাহিড়ী। তাঁর দাবি, ‘‘কখনওই কারও ট্রেড লাইসেন্স ফি মকুব করা হয়নি। সুবিধাও পাইয়ে দেওয়া হয়নি।’’ তা হলে মাত্র কয়েক মাসে কী করে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব আদায় বাড়াল হাওড়া পুরসভা? অরুণাভবাবুর কথায়, ‘‘এখন আর সে সব কী করে বলব?’’

হাওড়া পুরসভার ‘আইনের গুঁতো’ দেওয়ার নোটিসই মোক্ষম ওষুধের কাজ করেছে বলে মত পুরকর্তাদের। পুর-কমিশনার নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিষয়টি সামনে আসতেই শক্ত হাতে রাশ ধরতে শুরু করি। রাজস্ব দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আর তাতেই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে।’’

পুরসভা সূত্রের খবর, এপ্রিল থেকে জুন— মাত্র তিন মাসে বালি থেকে ট্রেড লাইসেন্স ফি বাবদ আদায় হয়েছে ৬০ লক্ষ টাকা। অরুণবাবুর দাবি, ‘‘এখনও পর্যন্ত বালির শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব জমা দিয়েছেন। সেই সংখ্যাটা অন্তত ৯০ শতাংশ করাটাই আমাদের লক্ষ্য।’’ তিনি আরও জানান, বালিতে ট্রেড লাইসেন্স ফি-র পরিমাণ বর্তমানে ধার্য হয়েছে, সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৬০-৭০ হাজার টাকা। তবে রাজস্ব বৃদ্ধির বি‌ষয়ে অরুণবাবুর যুক্তি, ব্যবসায়ীরা পানীয় জল, জঞ্জাল সাফাই-সহ বিভিন্ন পুর-পরিষেবার সুবিধা নিচ্ছেন। তাই বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ব্যবসার চরিত্র অনুযায়ী ফি-র পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘বেলুড়ের একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় বছরে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়। কিন্তু তারা রাজস্ব দিতেন মাত্র ১৫০০ টাকা। এখন ওই কারখানা থেকে বছরে প্রায় ৬৪ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে।’’

হাওড়া পুরসভার লাইসেন্স অফিসার সোমনাথ দাস জানান, বালির দায়িত্ব নেওয়ার পরে দেখা যায়— পুর-রেকর্ডে ট্রেড লাইসেন্সের সংখ্যার সঙ্গে বাস্তবের কারখানা কিংবা দোকান, বাজারের সংখ্যা মিলছে না। এই গরমিল দেখেই হাওড়া পুরসভা থেকে ৩২ জন ডেটা কালেক্টরকে পাঠানো হয় বালিতে। তাঁরাই বিভিন্ন কারখানা, দোকান পরিদর্শন করে তথ্য জোগাড় করেন। পাশাপাশি লাইসেন্স অফিসার, এমনকী খোদ মেয়র পারিষদও (রাজস্ব) নিজে আচমকা পরিদর্শন শুরু করেন। তাতেই দেখা যায়— কোনও ব্যবসায়ী শেষ ১৫ বছরে ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করেননি, কারও ট্রেড লাইসেন্সই নেই। কোথাও কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা চললেও ট্রেড লাইসেন্স ফি নেওয়া হয়েছে যৎসামান্য, কাউকে আবার কোনও দিন রাজস্ব দিতেই হয়নি। সোমনাথবাবু বলেন, ‘‘নোটিস ও এসএমএসে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হতেই এখন প্রতিদিন বালির ব্যবসায়ীরা এসে ফি জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।’’

বালি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অরুণাভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আগে এ নিয়ে পুরসভার তরফে কখনও কেউ কিছু বলতেনও না, আবার অনেক ব্যবসায়ী জানতেনও না। এ বার যে ভাবে পুরকর্তারা ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করালেন, তাতে কেউ আর রাজস্ব ফাঁকি দেবেন না।’’

Police Left alliance
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy