Advertisement
E-Paper

আলু ফলিয়ে কী হবে, টাটাকে ফেরান, রাহুলদের সামনেই দাবি তুলল সিঙ্গুর

উপলক্ষ ছিল আলুর সঙ্কট নিয়ে চাষিদের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু রবিবার সিঙ্গুরে গিয়ে বিজেপির প্রতিনিধিদলকে শুনতে হল টাটাদের ফেরানোর দাবি!বিজেপি নেতাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিঙ্গুরের চাষিরা দাবি তুললেন, “টাটাকে ফিরিয়ে আনুন। তা হলেই এখানকার মানুষ কাজ পাবেন। আলু চাষ করে আমরা ঋণে জর্জরিত। শিল্প হলে পরিস্থিতির বদল হবে।” যা শুনে বিজেপির প্রতিনিধিদলের তরফে দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে বলতে শোনা গেল, “চিন্তা করবেন না। এখানে টাটা আসবে।”

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৮
সিঙ্গুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলছেন বিজেপি নেতারা। রবিবার দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।

সিঙ্গুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলছেন বিজেপি নেতারা। রবিবার দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।

উপলক্ষ ছিল আলুর সঙ্কট নিয়ে চাষিদের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু রবিবার সিঙ্গুরে গিয়ে বিজেপির প্রতিনিধিদলকে শুনতে হল টাটাদের ফেরানোর দাবি!

বিজেপি নেতাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিঙ্গুরের চাষিরা দাবি তুললেন, “টাটাকে ফিরিয়ে আনুন। তা হলেই এখানকার মানুষ কাজ পাবেন। আলু চাষ করে আমরা ঋণে জর্জরিত। শিল্প হলে পরিস্থিতির বদল হবে।” যা শুনে বিজেপির প্রতিনিধিদলের তরফে দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে বলতে শোনা গেল, “চিন্তা করবেন না। এখানে টাটা আসবে।”

গত ন’বছর ধরে সিঙ্গুরকে কেন্দ্র করে রাজ্য-রাজনীতি কম উথালপাথাল হয়নি। ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পিছনে সিঙ্গুরকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বাম শিবিরেরও একটা বড় অংশ। যদিও সিপিএমের সদ্য সমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সে দিনও বলেছেন, রাজ্যের শিল্পায়নের স্বার্থেই তিনি সিঙ্গুরে কারখানা করার পথে এগিয়েছিলেন। সিঙ্গুরের টাটার ন্যানো কারখানা চালু হয়ে গেলে গোটা রাজ্যেরই শিল্পের ছবি বদলে যেতে পারত। সেটা যে হতো, তা একাধিক বারই প্রকাশ্যে জানিয়েছে দেশের শিল্পমহল। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদীও আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুর-সহ এ রাজ্যে সামগ্রিক শিল্পায়নের চেষ্টা করবেন। গত বছর মোদীর শপথ গ্রহণের দিনে সিঙ্গুরে টাটাদের পরিত্যক্ত জমিতে ফের শিল্পের দাবিতে মিছিলও হয়।

কিন্তু কিছুই হয়নি! ন্যানো-বিদায় ইস্তক সিঙ্গুর এক শিল্প-শ্মশান হয়েই রয়ে গিয়েছে বাংলার আর পাঁচটা জায়গার মতো! সেখানকার ‘অনিচ্ছুক’ চাষিরা আজও জমি ফেরত পাননি। সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর-মামলার শুনানি বারবার পিছোচ্ছে। বাড়ছে চাষিদের হতাশা। তার উপরে এ বার আলুর চাষে দাম না পেয়ে মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের অনেকেরই। তাঁদের সেই দুর্দশার কথা শুনতেই রবিবার সিঙ্গুরের ঘনশ্যামপুর মোড়ে যান বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া, দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ, বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যরা। উপস্থিত চাষিরা যখন তাঁদের দুর্দশার কথা বলছিলেন, সেই ফাঁকেই ভিড় থেকে দাবি ওঠে, টাটাকে ফিরিয়ে আনার।

তত ক্ষণে দেখা হয়ে গিয়েছে, মাঠের পর মাঠ আলু পড়ে রয়েছে। সিঙ্গুরের অন্যতম প্রধান ফসল আলু। ফলে সেখানে হাহাকার স্পষ্ট। চাষিদের এক কথা: টাটাকে আনো, শিল্প ফেরাও! রবিবার সেটাই আরও এক বার শুনল বিজেপির প্রতিনিধিদল। সিঙ্গুর যে শিল্প চাইছে, সেটা তৃণমূলও ভাল ভাবেই বুঝছে, কারণ তাদেরও এখন একই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। সম্মেলনে লোক জমছে না।

২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটে জিতে দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার দিনই সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে ন্যানো কারখানার জমি নিয়ে চুক্তি করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু সেই জমি জরিপের কাজে এলাকায় গেলে প্রথম স্থানীয়দের একাংশের কাছে বাধা পান টাটা গোষ্ঠীর লোকজন। সেই শুরু। তার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের চাপে ২০০৮ সালে সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যান রতন টাটা। গন্তব্য গুজরাতের সানন্দ। সিঙ্গুরের মানুষের একটা অংশ এই জমি আন্দোলন চালিয়ে যান। ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে মমতা প্রথমেই সিঙ্গুর আইন তৈরি করে জমি টাটাদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন। সেই আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যায় টাটারা। ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গুর আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেয়। তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। সেই মামলা এখনও চলছে। আর সিঙ্গুরের ভাগে জুটেছে দু’টাকা কেজি দরে সরকারি খয়রাতির চাল!

এর মধ্যে ন’বছর কেটে গিয়েছে। এখন কেন মত বদলাচ্ছেন সিঙ্গুরের চাষিরা? স্থানীয়দের কেউ কেউ বললেন, “ন্যানোর কারখানা হলে কী বদল হতে পারে, সেটা তো আমরা দেখেছি! ব্যাঙ্কের শাখা খুলল, মোটর সাইকেলের দোকান চালু হল। রাস্তার ধারে ধাবা-চায়ের দোকান রমরম করত।” যে ছবিটা এখন সানন্দে চলে গিয়েছে, বলছেন তাঁরা। সেখানে বাণিজ্যিক প্লটের দাম বেড়েছে দশ গুণের বেশি, ব্যাঙ্কের শাখা দুই থেকে এক লাফে বেড়ে ২৬ হয়েছে। জমি কেনাবেচার আলোচনাই সেখানে ব্যবসার মূল কথা। ন্যানোর পরে সেখানে চালু হল ফোর্ডের কারখানা। যার উদ্বোধনে এসে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন বলেছেন, “এর পর মারুতি-সুজুকি, হন্ডার মতো সংস্থাও আসবে। সানন্দই হবে ভবিষ্যতের ডেট্রয়েট।”

সংবাদমাধ্যমের হাত ধরে সানন্দের সেই ঝকঝকে ছবি পৌঁছে গিয়েছে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকের কাছেও। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের ক্ষোভ জমেছে। তা সামাল দিতে রাজ্য চাল ও টাকার বন্দোবস্ত করলেও তাতে যে বিশেষ লাভ হয়নি, রবিবার আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল। এ দিনের জমায়েতে থাকা অশোক দাস নামে এক চাষি বলেন, “কারখানা হলে তো ভালই হতো। সিঙ্গুর এবং আশপাশের চাষি বাড়ির ছেলেরা কাজ পেতেন।” বিফল বাঙালদের মতো অনেক চাষিরই বক্তব্য, ওই জমি আর চাষযোগ্য নয়। দরকার কারখানা।

রাজ্যের শিল্পমহল অবশ্য বলছে, ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে গেল! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পকর্তাদের বক্তব্য, এখন বোধোদয় হলেও সিঙ্গুর তথা গোটা রাজ্যে আদৌ শিল্পপতিরা আসবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েই যাচ্ছে। এর সব থেকে বড় কারণ, রাজ্য সরকারের জমি নীতি। যতই জাঁক করে নানা নামে বাণিজ্য সম্মেলন করুন মুখ্যমন্ত্রী, যে সব কথা শিল্পমহল শুনতে চায়, সেগুলি এখনও তাঁর প্রশাসন বলছে না। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে না এটা এখনও সরকারের ঘোষিত নীতি। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বাতিল করা নিয়েও কোনও উচ্চবাচ্য নেই। তা হলে?

সিঙ্গুর ঘোরার মধ্যে বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মুখে ঠিক এই কথাটাই শোনা গেল। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ভুল শিল্পনীতির জন্যই এই অবস্থা।” বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য একই সঙ্গে মমতা এবং বুদ্ধবাবুকে দুষে বললেন, “এক জনের অদূরদর্শিতা এবং আর এক জনের অনমনীয় মনোভাবের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে একটি শিল্প সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটেছে।”

এ দিন চাষিরা যে ভাবে ফের সিঙ্গুরে টাটাদের ফিরিয়ে শিল্প স্থাপনের দাবি তুললেন, তা নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি রাজ্যের মন্ত্রী তথা সিঙ্গুরের ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক বেচারাম মান্না। বিতর্ক এড়িয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি আদালতের বিবেচনাধীন। এ বিষয়ে মন্তব্য করব না।” তবে বিজেপির প্রতিনিধিদলের হুগলিতে আসা নিয়ে টিপ্পনী কাটতে ছাড়েননি মন্ত্রী। তিনি বলেন, “ওঁরা ঘোলাজলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন! গত উপ-নির্বাচনে পায়ের তলায় মাটি পাননি। সে জন্যই পরিযায়ী পাখির মতো এসেছেন! তাতে বিশেষ সুবিধা হবে না।”

বিজেপির এ দিনের সফরের পরে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলছেন, “বিজেপি সমর্থক মুষ্টিমেয় কিছু চাষি এ দিন টাটাদের ফেরানোর দাবি তুলতে পারেন। কিন্তু সিঙ্গুরের বেশির ভাগ ‘অনিচ্ছুক’ এখনও আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। তাঁরা আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।”

যা শুনে হুগলি জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি স্বপন পাল বলেন, “মুষ্টিমেয় কিছু চাষিকে নিয়েই তো প্রথমে আন্দোলন শুরু করেছিলেন মমতা। এ বার শিল্পের দাবিতে সিঙ্গুরের আরও বহু মানুষ সরব হবেন। কারণ তাঁরা ভাল নেই।”

southbengal potato singur Rahul Sinha BJP Tata Mamata bandopadhyay Mamata Banerjee trinamool tmc election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy