উড়ালপুল থাকলেও রেল লাইন পেরিয়ে দু’পাশের এলাকার মানুষের যাতায়াতের রোজকার ছবি।
রেল লাইনের দু’পাশের শহরকে জুড়েছে ঝাঁ চকচকে উড়ালপুল। আবার বলা যেতে পারে শহরকে ভাগও করেছে এই উড়ালপুলই। অন্তত এমনটাই মনে করছেন আবদুর রউফ, রীতা ভৌমিকের মতো পুরনো বাসিন্দারা।
হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় বাগনান স্টেশনে লেভেল ক্রসিং বন্ধ করে দিয়ে বছরখানেক চালু হয়েছে উড়ালপুল। শহরের উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে যান চলাচল এর ফলে অনেকটাই সুগম হয়েছে। বাগনান থেকে শ্যামপুরের মধ্যে চলাচল করতে এখন আর যানবাহনকে লেভেল ক্রসিংয়ের কোপে পড়তে হয় না। মহানন্দে বেড়েছে তাদের গতি। গতি বেড়েছে ট্রেনেরও। লেভেলক্রসিংয়ের দু’দিকে দীর্ঘক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকার সমস্যা আর নেই।
তবে অন্য সমস্যা এসেছে ঘুরপথে, আবদুর রউফ, রীতাদেবীর মতো রেলগেটের আশেপাশের মহাদেবপুর, শীতলপুর, গোবর্ধনপুর প্রভৃতি গ্রামে যাঁরা বাস করেন তাঁদের কাছে। উড়ালপুল চালু হওয়ার পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে লেভেলক্রসিং। লাইনের দু’ দিক বাঁধা পড়েছে মোটা মোটা লোহার খুঁটিতে। লেভেলক্রসিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সব গ্রামের মানুষগুলি আর সহজে শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে যেতে পারছেন না। যেতে হলে হয় তাঁদের অনেকটা পথ উজিয়ে গিয়ে উঠতে হবে উড়ালপুলে, নয়তো রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজ ধরতে হবে। পথচারীদের জন্য এমন উপায় হলেও বিপাকে পড়েছেন সাইকেল আরোহীরা। অনেকটা ঘুরপথের ঝক্কি এড়াতে বিপজ্জনক জেনেও বন্ধ লেভেলক্রসিংয়ের লোহার খুঁটির ফাঁকই বেছে নিয়েছেন তাঁরা লাইনের ওপারে যাওয়ার জন্য।
লোহার বেড়ার ফাঁক গলে ছেলেকে সাইকেলের পিছনে চাপিয়ে রেললাইন পার হচ্ছিলেন রউফ। এ ভাবে ঝুঁকি নিচ্ছেন কেন? প্রশ্ন শুনেই বিরক্ত মুখে বললেন, “কী করব? ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যেতে হলে লাইনের ওপারে যেতে হবে। এ ভাবে যাতায়াত করা ছাড়া উপায় নেই। উড়ালপুল দিয়ে ঘুরতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।” একইভাবে লোহার ফাঁক গলে হেঁটে লাইন পার হচ্ছিলেন রীতাদেবী। রউফ এবং রীতা দু’জনেই মহাদেবপুরের বাসিন্দা। রীতাদেবীর কথায়, “কী কষ্ট করে যে যাতায়াত করি বলার নেই। ছোটখাটো হলেও শুধু হাঁটাচলার জন্য লেভেলক্রসিং রাখলে ভাল হত। উড়ালপুল হল বটে। আমাদের সমস্যা কিন্তু থেকেই গেল।”
দক্ষিণ-পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সারা দেশেই নিয়ম হল লেভেলক্রসিংয়ের বদলে উড়ালপুল তৈরি হলে লেভেলক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া। আর ছোটখাটো লেভেলক্রসিং রাখলেও তার জন্য পরিকাঠামো চালু রাখতে হয়। সেটাও করা যায় না। শুধু রউফ বা রীতা নন, এলাকার অন্য বাসিন্দারাও বিকল্পের কথা তুলেছেন। তাঁদের দাবি, আপ লাইনের ধার বরাবর একটি রাস্তা তৈরি করে সেটিকে পশ্চিম কেবিনের কাছে হেতমপুর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। সেখানে লেভেলক্রসিং রয়েছে। তা হলে বাসিন্দাদের শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাতায়াত সহজ হবে। রেলের বক্তব্য, প্রস্তাব এলে আলোচনা করা যেতে পারে।
বাগনান শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে রেলপথ। শহরের উন্নতি অনেকটাই রেলপথ নির্ভর। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ বাগনানে আসেন। ট্রেন ধরে কলকাতা-সহ শহরতলিতে যাতায়াত করেন। শহরের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা স্টেশন রোড উত্তর ও স্টেশন রোড দক্ষিণ। দু’টি রাস্তার ধারেই রয়েছে অসংখ্য দোকানপাট। মূলত ট্রেনযাত্রীদের উপরে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক বাগনান।
বাসস্ট্যান্ডে যেতে উপায় রেল লাইনই। ছবি: সুব্রত জানা।
কিন্তু এত মানুষ যেখানে রেলের সঙ্গে জড়িত সেখানে রেলের পরিষেবা থেকে গিয়েছে সেই মান্ধাতা আমলেই, এমনটাই অভিযোগ নিত্যযাত্রী ও বাসিন্দাদের। যাতায়াতের সুবিধার্থে তাঁদের দাবি বাগনান স্টেশনে একটি আন্ডারপাস। যাত্রীদের বক্তব্য, আপ ও ডাউন দুটি লাইনেই লোকাল ট্রেন স্টেশনে আসার সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ ট্রেন থেকে নেমে বাস, অটো এবং ট্রেকার ধরতে ছোটেন। তাড়াহুড়োর কারণে বেশিরভাগই ওভারব্রিজ ব্যবহার করেন না। বাসস্ট্যান্ডে যাতায়াত করতে হয় পুরোপুরি রেল লাইনের উপর দিয়ে। ফলে প্রতি মূহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। নিত্যযাত্রীদের বক্তব্য, প্লাটফর্মের পূর্ব দিক থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সাবওয়ে হলে দুর্ভোগ কমে।
যদিও দক্ষিণ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ বলেছেন, “যাত্রীদের উন্নত পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সব সময়েই সচেষ্ট। তাঁদের তরফে যদি গ্রহণযোগ্য কোনও প্রস্তাব আসে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য আমরা সবসময়েই রাজি।”
দক্ষিণ-পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বাগনান স্টেশনে সাবওয়ে তৈরির জন্য সমীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে জলের স্তর উঁচু হওয়ার কারণে সাবওয়ে তৈরির প্রকল্প বাতিল করা হয়। রেলের এই যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ যাত্রীরা।
যাত্রী সংগঠনের তরফে অজয় দলুই, রতনচন্দ্র ঘোষ বলেন, “মনে হয় না আধুনিক যুগে এ ধরনের সমস্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাতাল রেল যে ভাবে তৈরি হচ্ছে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তো সাবওয়ে করা যেতে পারে।” রেলের পাল্টা যুক্তি, পাতাল রেল তৈরি হয় অনেকটা জায়গা নিয়ে। একটা স্টেশনের সাবওয়ের সঙ্গে কখনওই তার তুলনা চলে না।”
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy