Advertisement
E-Paper

তিন সপ্তাহ মহিলা বিচারকের এজলাস বয়কট শ্রীরামপুরে

বিচারকই এখন বিচারপ্রার্থী। সারদা-কাণ্ডে মন্ত্রী মদন মিত্রের হাজিরার সময়ে বিচারককে উদ্দেশ করে হুমকি দিয়েছিলেন এক দল আইনজীবী। তাতে অবশ্য বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়নি। কিন্তু শ্রীরামপুর আদালতে এক মহিলা বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ তুলে তাঁর এজলাস বয়কট শুরু করেছেন আইনজীবীরা। এক-দুই দিন নয়, টানা তিন সপ্তাহ ধরে এই এজলাস বয়কট চলার পরে বুধবার ওই দেওয়ানি বিচারক (সিনিয়র ডিভিশন) মন্দাক্রান্তা সাহার ঘরের সামনে আইনজীবীদের বিক্ষোভের জেরে গোটা আদালত চত্বরের কাজকর্মই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৭
বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহা। ছবি: প্রকাশ পাল।

বিচারক মন্দাক্রান্তা সাহা। ছবি: প্রকাশ পাল।

বিচারকই এখন বিচারপ্রার্থী।

সারদা-কাণ্ডে মন্ত্রী মদন মিত্রের হাজিরার সময়ে বিচারককে উদ্দেশ করে হুমকি দিয়েছিলেন এক দল আইনজীবী। তাতে অবশ্য বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়নি। কিন্তু শ্রীরামপুর আদালতে এক মহিলা বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ তুলে তাঁর এজলাস বয়কট শুরু করেছেন আইনজীবীরা। এক-দুই দিন নয়, টানা তিন সপ্তাহ ধরে এই এজলাস বয়কট চলার পরে বুধবার ওই দেওয়ানি বিচারক (সিনিয়র ডিভিশন) মন্দাক্রান্তা সাহার ঘরের সামনে আইনজীবীদের বিক্ষোভের জেরে গোটা আদালত চত্বরের কাজকর্মই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

সংবিধান-বিরোধী

সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা এই ভাবে আদালতের কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হুট-হাট আদালতের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট এ নিয়ে কড়া মনোভাব ব্যক্ত করেছে। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী মহলও দ্বিধাবিভক্ত। এমতাবস্থায় কলকাতার খুব কাছেই শ্রীরামপুর আদালতের একটি এজলাসে টানা তিন সপ্তাহ ধরে আইনজীবীদের আন্দোলনে কাজ বন্ধ থাকায় কেন হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কলকাতার বেশ কয়েক জন আইনজীবী। ওই বিচারক নিজে হাইকোর্টের কাছে বিষয়টি জানিয়েছেন। তাতেও শ্রীরামপুরের ওই বিচারক তাঁর এজলাসে বসে কাজ করতে পারছেন না।

তবে বুধবার এ ব্যাপারে মন্দাক্রান্তাদেবীর সঙ্গে কথা বলেছেন হুগলির জেলা বিচারক জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের কেউই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। তবে গণ্ডগোলের জেরে আখেরে বিভিন্ন মামলার বিচারপ্রার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে বলেই মনে করছেন হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতিরা।

কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “ওই আদালতে যা চলছে, তা বিচার ব্যবস্থার উপরে প্রচণ্ড আঘাত। আন্দোলনকারীরা বুঝতে পারছেন না, নিজেদেরও ক্ষতি করছেন এ ভাবে। ওঁরা এ যুগের কালিদাস।”

রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ আছে, আদালতে এ রকম বিক্ষোভ-আন্দোলন চালাতে দেওয়া যায় না।” আর এক প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “বিচারকের উপরে কারও নির্দিষ্ট ক্ষোভ থাকলে তিনি প্রথামতো হাইকোর্টে আবেদন করতে পারেন! তা না করে যা করছেন, সেটা আদালত অবমাননার সামিল।”

হাইকোর্টের ভূমিকা

তবে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ পুরো বিষয়টির জন্য কলকাতা হাইকোর্টের ‘নিষ্ক্রিয়তা’-কেও দায়ী করেছেন। অরুণাভবাবু বলেন, “আলিপুর আদালতের মধ্যে বসে মন্ত্রী মদন মিত্র মোবাইলে কথা বলেছেন। এক শ্রেণির আইনজীবী এজলাসের ভিতরেই বিচারককে হুমকি

দিয়েছেন। সেখানেও হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। তারা তা করেনি। এ ক্ষেত্রেও হাইকোর্টের নিষ্ক্রিয়তায় বস্তুত উচ্চতর আদালতেরই সম্মানহানি ঘটছে।”

কলকাতা হাইকোর্ট সূত্রের খবর, প্রবীণ আইনজীবীদের মধ্যে কে কোন জেলা আদালত দেখবেন তার দায়িত্ব ভাগ করা থাকে। সেইমতো হুগলি জেলার আদালতের বিষয়গুলি দেখার কথা বিচারপতি নিশীথা মাত্রের। গত কয়েক দিন বিচারপতি মাত্রে অনুপস্থিতি থাকার পরে মঙ্গলবার তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি ওই বিচারকের অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন হাইকোর্টের ওই সূত্রটি।

বিষয়টি জানা থাকলেও দূরত্ব বজায় রেখেছেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, বিচারকের কোনও অভিযোগ থাকলে তিনি জেলা বিচারক বা হাইকোর্টকে বিষয়টি জানাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা নেই।

তবে আইনজীবীদের একাংশের জন্য বিচারের কাজ ব্যাহত হচ্ছে এই অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের কাছে এ দিনই একটি প্রতিবাদপত্র জমা দিয়েছে ‘পশ্চিমবঙ্গ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিনিধি দল।

কেন আন্দোলন

আইনজীবীদের একাংশের অভিযোগ, গত ৭ জানুয়ারি মন্দাক্রান্তাদেবীর এজলাসে একটি মামলার শুনানির সময় বার লাইব্রেরির সম্পাদক রামচন্দ্র ঘোষ তাঁর একটি মামলার শুনানির দাবি জানান।

বিচারক তাঁকে জানান, ওই মামলার শুনানি কিছু ক্ষণ পরে হবে। রামচন্দ্রবাবু বিষয়টি মানতে পারেননি। বিচারক ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁকে বসিয়ে রাখছেন মনে করে তিনি এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে যান। সঙ্গী হন অন্য আইনজীবীরাও। শুরু হয় বয়কট। মন্দাক্রান্তাদেবী অবশ্য রোজই আদালতে এসেছেন।

আবেদন বিফল

পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ওই আদালতে গিয়ে আইনজীবীদের মন্দাক্রান্তাদেবীর এজলাস বয়কট তুলে নিতে আর্জি জানান জেলা বিচারক। কিন্তু তাতে বরফ গলেনি। উল্টে হুগলি জেলার চারটি মহকুমা আদালত এবং জেলা আদালতেও এক দিনের কর্মবিরতি পালন করেন আইনজীবীরা।

বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ এজলাসে ওঠেন মন্দাক্রান্তাদেবী। কিছু ক্ষণ পরেই তাঁর ঘরের সামনে এবং আদালতের ওই ভবনে ঢোকার মুখে আইনজীবীরা ভিড় করতে থাকেন। তুমুল হট্টগোল বাধে। আইনজীবীরা সিদ্ধান্ত নেন, এ দিন আদালতে তাঁরা কোনও কাজ করবেন না।

আন্দোলনকারী আইনজীবীদের তরফে কমলেশকুমার ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “বিচারপ্রার্থীদের জন্যই আমাদের এই আন্দোলন। যাঁদের আইন-জ্ঞান কম, তাঁরাই বিচারে দেরি হচ্ছে বলে তাড়াহুড়ো করছেন।” অর্থাৎ শ্রীরামপুরে চলবে এজলাস বয়কটের আন্দোলন।

mandakranta saha serampore judge tmc court boycott
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy