Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পানতুয়া, কাঁচাগোল্লাতেই মজেছেন মিষ্টিপ্রেমীরা

প্রায়ান্ধকার ছোট দোকান। আর পাঁচটা সাধারণ মিষ্টির দোকানের সঙ্গে তফাত্‌ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দোকানে বসেই শালপাতার ঠোঙায় খরিদ্দারদের হাতে পানতুয়া তুলে দিলেন দোকানের মালিক নারায়ণ চরিত। মিষ্টিরসিকদের কাছে পানতুয়া নতুন শব্দ নয়। তবে চরিত্রে আমতার পানতুয়া আলাদা। আগে খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের হবে না।

ছবি: সুব্রত জানা।

ছবি: সুব্রত জানা।

নুরুল আবসার
আমতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৪৬
Share: Save:

প্রায়ান্ধকার ছোট দোকান। আর পাঁচটা সাধারণ মিষ্টির দোকানের সঙ্গে তফাত্‌ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দোকানে বসেই শালপাতার ঠোঙায় খরিদ্দারদের হাতে পানতুয়া তুলে দিলেন দোকানের মালিক নারায়ণ চরিত।

মিষ্টিরসিকদের কাছে পানতুয়া নতুন শব্দ নয়। তবে চরিত্রে আমতার পানতুয়া আলাদা। আগে খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের হবে না। এই পানতুয়া ভেঙে মুখে তুলতে গেলেই পিচকিরির মতো ভিতর থেকে রস ছিটকে বেরিয়ে আপনার জামা ভিজিয়ে দিতে পারে। অতএব সাধু সাবধান!

নারায়ণবাবুর দোকানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা গেল পানতুয়া যাঁরা কিনছেন, সাবধানে তা ভেঙে টুকরো করে মুখের ভিতরে ফেলছেন। তারপর গোটা মুখমণ্ডলে তৃপ্তির ছায়া। মুষ্টিমেয় কিছু আগন্তুক ছাড়া শহরের বেশিরভাগ মানুষ এই ঘরানার পানতুয়ার সঙ্গে পরিচিত। আর আছে কাঁচাগোল্লা। আমতার কাঁচাগোল্লা মুখে দিলে একটু পরেই সাবুর দানার বস্তুত আমতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই পানতুয়া আর কাঁচাগোল্লা। ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৩৮টি মিষ্টির দোকান আছে শহরে। যদিও নারায়ণবাবুদের দোকানের ধার ও ভার অনেকটাই বেশি বলে স্বীকার করলেন অন্য মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা। শহরে মিষ্টির দোকানের প্রবর্তনও নারায়ণবাবুদের দোকানের হাত ধরে।

তবে মিষ্টি ছাড়াও ঐতিহ্যের আকর আরও আছে এ শহরে। জেলার অন্যতম প্রাচীন এই শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া দামোদরের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল নৌ পরিবহণ। শহরের অদূরে বেতাই পরিচিত ছিল বন্দর হিসাবে। কারণ এখানেই বড় বড় নৌকা ভিড়ত। পণ্যবাহী সে সব নৌকায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র আসত। কিন্তু ক্রমে দামোদরের নাব্যতা কমে যাওয়ায় অস্তিত্ব হারায় বন্দর। নৌ-পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষজন বাঁচার তাগিদে পা বাড়ান অন্য পেশায়। তবে আমতার ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় বেতাই। শহরের প্রবীণেরা আজও স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠেন এখানকার মার্টিন রেলের কথা উঠলে। পুরনো সেই মার্টিন রেলের আমতা টার্মিনাল স্টেশনের কাছেই এখন নিজের কংক্রিটের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আমতা-১ ব্লক প্রশাসন কার্যালয়। বাস্তব অস্তিত্ব হারালেও মানুষের স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে সেই স্টেশন।

ব্রিটিশ আমলে আমতা ব্লক সদরে গড়ে উঠেছিল আদালত। রাজ্যের মধ্যে একটি ব্লক সদরে আদালত গড়ে ওঠার তেমন নজির নেই বলে জানালেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। ইংরেজ রাজত্বের অবসান হলেও সেই আদালত ধীরে ধীরে কলেবরে বেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আজও একে শহরের অন্যতম ঐতিহ্য বলে মনে করেন। শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মেলাইচণ্ডীর মন্দির। প্রাচীন এই মন্দির বছরভর গম গম করে হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে। মন্দিরের সৌজন্যে এ শহরের আরও একটা নাম মন্দির শহর। মন্দিরেরই উল্টোদিকে একটি দোকানে খই-মুড়কি বিক্রি করতেন এক বিধবা। সালটা ১৮৭৭। এক সময় সেখানে চাকরি করতে আসেন ভূপতি চরিত নামে বছর দশেকের এক বালক। মহিলা মারা যাওয়ার আগে ভূপতিকেই ভার দিয়ে যান দোকানের। তবে ভূপতি খই-মুড়কির ধার দিয়েও গেলেন না। বদলে দুই ভাই শ্রীপতি ও পশুপতিকে নিয়ে নেমে পড়লেন মিষ্টি তৈরির ব্যবসায়। তৈরি করলেন পানতুয়া ও কাঁচাগোল্লার নিজস্ব রেসিপি। যার মাহাত্ম্যে ভূপতি ময়রা তথা চরিতদের দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়ল জেলার বাইরে। চরিতদের এই সাফল্য শহরে টেনে আনল আরও মিষ্টি ব্যবসায়ীকে। কিন্তু সেরা থেকে গিয়েছে সেই ভূপতি ময়রার মিষ্টি।

পানতুয়া আর কাঁচাগোল্লার দৌলতে আমতার নাম অবশ্য এখন দেশের গণ্ডী ছাড়িয়েছে বলে নারায়ণবাবু জানালেন। তাঁর কথায়, “এই শহরের বহু মানুষ বিদেশে থাকেন। তাঁদের কাছে এদেশের আত্মীয় মারফত আমাদের দোকানের পানতুয়া পৌঁছে যায়।” এমনকী উত্তমকুমারের মতো মানুষও তাঁদের দোকানের পানতুয়া খেয়েছেন বলে নারায়ণবাবুর দাবি। বললেন, “১৯৬৬ সালে আমতার কিছু এলাকায় বন্যা হয়। তা দেখতে এসেছিলেন উত্তমকুমার, বিকাশ রায় ও পাহাড়ি সান্যাল। মনে আছে ভাইদের নিয়ে আমি তিনজনকে পানতুয়া দিয়ে এসেছিলাম। নৌকায় বসে তাঁরা খেয়েছিলেন। এটা আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি।”

কিন্তু সাবেক আমলের প্রায়ান্ধকার ঘরের আধুনিকীকরণে নজর দেননি? প্রশ্ন শুনে কিছুটা থেমে হেসে ফেলে মন্তব্য, “ইচ্ছা করেই করিনি। দোকানের চেহারা যেমনই হোক না কেন, মানুষ তো মিষ্টির রসেই মজবে।”

সত্যিই তো। রসেই তো মজে সবাই। দোকান থেকে বেরোনোর সময় দেখা গেল নারায়ণবাবুর মুখের হাসিটা আরও চওড়া হয়েছে।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor nurul absar amta sweets
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE