Advertisement
E-Paper

ব্যাটন নেওয়ার লোক খুঁজছে বালি গ্রন্থাগার

পাড়ার নাটকের দল হোক বা সিনে সোসাইটি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোক কমছে সব জায়গাতেই। আর ক’দিন বাদেই যে ৭৫ বছরে পা দিতে চলেছে, বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের সেই কর্মিসঙ্ঘও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রবীণ সদস্যদের আক্ষেপ, নবীন সদস্যরা আর আগ্রহী নয় স্বেচ্ছাসেবক হতে।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৪ ০১:২৩
১৩০ বছরেও সজীব বালি সাধারণ গ্রন্থাগার।—নিজস্ব চিত্র।

১৩০ বছরেও সজীব বালি সাধারণ গ্রন্থাগার।—নিজস্ব চিত্র।

পাড়ার নাটকের দল হোক বা সিনে সোসাইটি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোক কমছে সব জায়গাতেই।

আর ক’দিন বাদেই যে ৭৫ বছরে পা দিতে চলেছে, বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের সেই কর্মিসঙ্ঘও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রবীণ সদস্যদের আক্ষেপ, নবীন সদস্যরা আর আগ্রহী নয় স্বেচ্ছাসেবক হতে।

হাওড়া জেলার এই গ্রন্থাগারটি শতাব্দী-প্রাচীন। ১৮৮৫ সালে বালির গোস্বামী বাড়িতে হরিধন গোস্বামী এবং নিবারণ পাঠকের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। সেই সঙ্গেই পরে গড়ে ওঠে একটি ছোট্ট গ্রন্থাগার। তার নেপথ্যে ছিল জাতীয়তাবাদী চিন্তা। ১৩০ বছরে সেই গ্রন্থাগার আড়ে-বহরে বেড়েছে, দেখেছে ইতিহাসের উত্থান-পতন। স্বাধীনতা আন্দোলন যখন শেষপর্বে তার চূড়ান্ত চেহারা নিচ্ছে, ১৯৪০-এর সেই উজ্জীবিত সময়ে গ্রন্থাগারে স্থাপন করা হয় কর্মিসঙ্ঘ।

ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও দেশব্রতের বাসনা নিয়েই রতনমণি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব ১২ অগস্ট শুরু হয়েছিল কর্মিসঙ্ঘের পথ চলা। দিনটা ছিল জন্মাষ্টমী। আজও জন্মাষ্টমীতেই পালিত হয় কর্মিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা দিবস। বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক গৌতম দত্ত বলেন, “ওই দিন গীতা পাঠ করা হয়। তবে তার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার কোনও সম্পর্ক নেই। গীতার মাধ্যমে স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে কর্মযোগের আদর্শ তুলে ধরা হয়েছিল। আমরা সেই রীতিই বহন করে চলেছি।”

ধারে-ভারে বালি সাধারণ গ্রন্থাগার এখনও রীতিমতো জীবিত। প্রায় ৪২ হাজার বই, ১৬ হাজার সাময়িকপত্রের সংগ্রহ রয়েছে সেখানে। গত শতাব্দীর আটের দশকে গ্রন্থাগারটি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে চার জন সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। শিশু-কিশোরদের জন্য পৃথক ভবনে রয়েছে সর্ম্পূণ পৃথক একটি বিভাগ । সেখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ারা বিনামূল্যে সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারে। শুধু বই পড়া নয়। রয়েছে সাহিত্যসভার ব্যবস্থাও। নিয়মিত আলাপ-আলোচনা, শিক্ষামূলক প্রশ্নোত্তর, জীবনীপাঠ এমনকী ছবি আঁকার প্রশিক্ষণও দেওয়া বিনামূল্যে। সারা বছর নানা রকম অনুষ্ঠান-প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। হয় রক্তদান শিবির। সামনের রবিবার, জন্মাষ্টমীতে যে ৭৫ বছর উদ্‌যাপনের সূচনা হচ্ছে, তাকে ঘিরে এক বছর ধরে চলবে নানা কর্মসূচি।

কিন্তু তা সত্ত্বেএ কর্মিসঙ্ঘ হীনবল হচ্ছে। সদস্যেরা সকলেই প্রবীণ। সর্বকনিষ্ঠ কর্মীবন্ধুও চল্লিশ ছঁুয়েছেন। এক সময়ে গ্রন্থাগারের শিশু বিভাগে যাতায়াত করতে-করতেই এঁরা সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। আজও দিনের অনেকটা সময় তাঁরা গ্রন্থাগারে কাটান। সরকারি কর্মীদের পাশাপাশি অনেকটা কাজ তাঁরাই করে দেন। নিজেদের কাজ আর সংসারের ফাঁকে সময় করেই। সঙ্ঘের বর্তমান সম্পাদক উত্‌পল মুখোপাধ্যায় এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মী। তবু নিয়মিত আসেন গ্রন্থাগারে। তাঁর কথায়, “আমার তো শিফটিং ডিউটি। তাই সকাল-বিকেল, যখন সময় পাই চলে আসি।” উত্‌পলবাবুর বন্ধু মানস কুমার মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, আট মাস বাইরে থাকেন। বাকি চার মাস বাড়ি ফিরে শুধুই গ্রন্থাগারে। এমন অনেক সদস্যও আছেন, যাঁরা এখন বালি ছেড়ে কলকাতা বা অন্যত্র বাসা বেঁধেছেন। তাঁরাও কিন্তু সপ্তাহের একটা দিন আসেন গ্রন্থাগারে এসে কাজ করেন।

সমস্যা হল, নতুন ছেলেমেয়েরা প্রায় কেউই সঙ্ঘে যোগ দিচ্ছে না। শিশু বিভাগে এখনও ৮০ জন সদস্য। তারা আসে নিয়মিত। কিন্তু সে তো দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। তার পরে আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। কর্মিসঙ্ঘের প্রবীণ সদস্য প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায় আক্ষেপ করেন, “শিশুরা এখনও আসে। বই বদলে নিয়েই হাঁটা দেয়। বাবা-মা দাঁড়িয়ে থাকেন বাইরে। এখান থেকেই সোজা নিয়ে যাবেন গৃহশিক্ষকের কাছে!” গৌতমবাবু তোলেন নিজের ছেলের ব্যস্ততার কথাই। বলেন, “আমার ছেলেও এক সময়ে শিশু বিভাগের সদস্য ছিল। উত্‌সবে-অনুষ্ঠানে আজও আসে। রক্তদান শিবিরে রক্ত দেয়। কিন্তু ওইটুকুই। সারা বছর আর তার দেখা পাওয়া যায় না। স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার সময় তার কই?”

পরের প্রজন্ম যখন পেশার দৌড়ে জায়গা নিতে ব্যস্ত, নৌকা ভাসিয়ে রাখার লোক খুঁজছেন রাজ্যের অন্যতম ঐতিহ্যশালী গ্রন্থাগারের মাঝিমাল্লারা।

bali library paromita mukhopadhay southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy